Connect with us

গল্প

লতি চিংড়ির ঝাল গলার কাছে আটকে থাকে…কিভাবে তেতোয় পরিণত হল, বোঝার চেষ্টা করে…

Published

on

লতি চিংড়ির ঝাল

যুগান্তর মিত্র

সকাল সকাল দেওর বাবুলাল এসে হাজির। সঙ্গে জা মুনাই আর ছোট্ট মেয়েটাও। ওদের আসতে দেখেই বেশিমাত্রায় মেজাজটা খিঁচরে যায় বিলাসীর।
গতকাল রাতে শান্তিলাল কারখানা থেকে ফিরে জানিয়েছিল, বাবুলাল আসবে বউ-মেয়েকে নিয়ে। মাকে দেখতে আসছে। শোনা ইস্তক মাথাটা চিড়বিড় করা শুরু হয়েছে। মায়ের ভাত-কাপড়ের বেলায় দাদার দায়িত্ব। নিজেরা ভিন্ন থাকবে আরামে! এখন বুড়িকে দেখতে আসছে। দরদ যেন উথলে উঠছে! মনে মনে বলেছিল বিলাসী। কিন্তু উচ্চারণ করতে পারেনি। শান্তিলাল ভাইয়ের কোনও দোষ দেখতে পায় না। তাই বলে লাভ নেই কিছু, জানে সে।
তেজপাতা আর জিরে ফোঁড়ন দিয়ে চিংড়িগুলো সবে ভেজে তুলে রেখেছে বিলাসী। সঙ্গে দিয়েছে পেঁয়াজ কুচি। এই সময়ই বাবুলালের গলা পেয়েছিল সে।
কই গো বৌদি, রান্নাবান্না হল?
আহা! বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই রান্নার খোঁজ নিতে শুরু করলে দেখছি! ওদের কি আর কোনও কামকাজ নাই? তুমি আসবে বলে সকালবেলাতেই রান্না চড়াবে? বারান্দায় জুতো জোড়া খুলতে খুলতে ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল মুনাই। বাবুলালের গলা শুনতে পেলেও মুনাইকেই আগে চোখে পড়েছে বিলাসীর।
সকালে শান্তিলাল বাজার থেকে রুইমাছ, কুচো চিংড়ি, মোটা মোটা লতি এনে দিয়েছিল। ভাই ভালোবাসে চিংড়ি দিয়ে লতি। ঝাল ঝাল করে রান্নার কথাও বলে দিয়েছে শান্তিলাল। রুইয়ের পেটি আবার মুনাইয়ের পছন্দ। মেয়েটা ছোট। ওকে খাইয়ে দিতে হয়। তাই মাছের যে দিকটাই হোক, কোনও অসুবিধা নেই। কাঁটা বেছে দিলেই হবে। বিলাসীকে শান্তিলাল বলেছিল। এত কিছুর দিকেও খেয়াল রেখেছে লোকটা! এইসব আদিখ্যেতা দেখেও মুখে রা কাড়েনি বিলাসী। নিজের ভাই, ভাইয়ের বউয়ের জন্য বাজারহাট করুক না। যত খুশি খেয়াল রাখুক। তাতে বিলাসীর কী যায়-আসে। কিন্তু যে ভাই ছ’মাসে-ন’মাসে মায়ের খোঁজ নেয় না, দাদার কথা বাদই থাক, তার জন্য দরদ দেখলে মাথা গরম হবেই। তোরই তো মা, তা খোঁজখবর রাখতে হয় না? নাকি খাওয়াপরার বা চিকিৎসার জন্য টাকাপয়সা দেওয়ার ভয় পাস? সরকারি চাকরি করিস। মাইনে তো কম পাস না! চালচলন দেখলে মনে হয় লাটের বাট! শুধু মাকে দেখার বেলায়… মনে মনে এসবও বারকয়েক আওড়ে গেছে বিলাসী।
বাবুলালের গলা শুনে গ্যাসের আগুন কমিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল সে। মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলতে হয়েছিল, এসো ঠাকুরপো, মার ঘরে গিয়ে বোসো। আমি চা করে দিয়ে আসব’খন। তুমি থামো তো দিদি, স্টেশনে নেমেই চা খেয়ে তবে টোটোয় উঠেছে। এখন আর চা করতে হবে না। বলে উঠেছিল মুনাই।
তা বললে হবে! কতদিন বাদে এলে তোমরা! মুখ টিপে বলেছিল বিলাসী। অনেকদিন বাদে যে এদের পা পড়ল এ বাড়ি, সেকথা শুনিয়ে দিতে পেরে ভালো লেগেছিল তার।
অ্যাই দেখো বৌদি, আমার চা খাওয়া নিয়ে মুনাইয়ের যত রাগ। তুমি ওর কথা ছাড়ান দাও। চা করো তো বেশ জমিয়ে।
চোখ কপালে তুলে মুনাই বলেছিল,
তুমি আবার চা খাবে এখন? এইতো আধ ঘণ্টাও হয়নি…
চুপ করো তো। চা খেতে অত সময়ের হিসেব করলে চলে না। এর জন্য কি পাঁজিপুঁথি দেখতে হয় নাকি? তুমি চা বানাও বৌদি। আর হ্যাঁ, বিস্কুটও দিও। শুধু চা আমার ভালো লাগে না, জানো তো।
হ্যাঁ জানি। তোমরা বোসো। আমি চা বসাচ্ছি। তারপর জলখাবার দিচ্ছি। তোমার দাদা দোকান থেকে পরোটা এনে রেখেছে।
বেশ বেশ। খুব ভালো। হাসিমুখে কথাটা বলেই মায়ের ঘরে ঢুকে পড়েছিল বাবুলাল। মেয়ে কিন্তু পরোটার তরকারি খেতে পারবে না দিদি। দোকানের তরকারির ঝাল খেতে পারে না এট্টুও। ওকে না-হয় চিনি দিয়েই পরোটা দিও।
মুনাইয়ের কথার কোনও জবাব না-দিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে বিলাসী। ওভেনের আগুন বাড়িয়ে দেয়। লতি সেদ্ধ বসিয়েছে সে। একটু সেদ্ধ হলেই নামিয়ে নিতে হবে। বেশি তুলতুলে হয়ে গেলে আবার ঘেঁটে ঘণ্ট হয়ে যাবে লতি-চিংড়ি। পাশের ওভেনে চা বসিয়ে দ্রুত মিটসেফ খুলে কৌটো ঝাঁকিয়ে দেখে নিল বিস্কুট আছে কিনা। আছে বুঝতে পেরে স্বস্তি পায় বিলাসী। গুঁড়ো দুধের কাচের বয়াম নিতে গিয়েই তার পাশের প্লাস্টিকের সাদা বাক্সটার দিকে চোখ পড়ে তার। ভুলেই গিয়েছিল সে। দুলাল সরদারের রেশন দোকানে যাওয়ার সময় বারবার বলে দিয়েছিল শান্তিলাল, ওরা এলে চাবিটা দিও মুনাইয়ের হাতে। ঘর সাফসুতরো করাই আছে। ওখানে বিশ্রাম নিতে পারবে। চায়ের জল ফুটে উঠেছে। দু’চামচ চা পাতা ফেলে দিল বিলাসী তাতে। এবার দুধ গুলে মিশিয়ে ঢেকে রাখবে। বাবুলাল চিনি ছাড়া দুধ-চা খায়। মুনাইয়ের আবার চিনি দেওয়া চাই।
দুলালদার দোকানে কার্ডটা জমা থাকে। রেশন খুব-একটা তোলা হয় না। তাই একদিন দুলাল সরদার বলেছিল, রেশন তো তুলিস না। কার্ডটা আমার কাছেই থাক। দরকার হলে নিস। সেই থেকে কার্ডটা ওর দোকানেই আছে। বাবুলালের নাকি রেশন কার্ড খুব দরকার। গতকালই দুলালদাকে বলে এসেছে শান্তিলাল আজ সকালে গিয়ে নিয়ে আসবে। সেইজন্যই যাওয়া। শান্তিলাল ফিরে যদি দেখে চাবি দেওয়া হয়নি, তাহলে রেগে যাবে খুব।
মুনাইয়ের হাতে চাবি দিয়ে রান্নাঘরে এসে লতি নামিয়ে রাখে বিলাসী। কড়াই বসিয়ে তাতে দু’চামচ সর্ষের তেল দেয়। কড়াই গরম হতে হতে তার মাথাও গরম হয়ে ওঠে সেদিনের কথা মনে পড়ায়। এসবের মধ্যেই তপ্ত কড়াইতে লতি আর চিংড়িগুলো ঢেলে দেয়। এরপর জিরের গুঁড়ো, ধনের গুঁড়ো, হলুদ দেয় বিলাসী। নাড়তে থাকে বেশ করে।
আমি হপ্তাখানেক বাদে চাকদা চলে যাব দাদা। এবার থেকে ওখানেই থাকব। আমার ঘরে না-হয় আপাতত তালা মারা থাকবে।          ওখানে থাকবি মানে?
আমার শাশুড়ি শয্যাশাযী, শুনেছিস তো! কে দেখবে বুড়িকে? একা মানুষ। কাজের লোক রাখার সাধ্য আছে ওনার? আমিই কি পারব সাহায্য করতে?
তা সবকিছু ঠিক করেই ফেলেছিস? শান্তিলাল ভাইয়ের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলেছিল কথাটা। মাথা নামিয়ে নিয়ে বাবুলাল বলেছিল, কী করব দাদা, ওনাকেও তো দেখতে হবে! একা বিধবা মানুষ…

    তা তোমার মাও তো অসুস্থ, বিছানায় শয্যাশায়ী ক’বছর হল।
বলে ফেলেছিল বিলাসী। তারপরেই মনে হয়েছিল, এভাবে বলাটা ঠিক হল না বোধহয়। কেননা কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শান্তিলাল তার দিকে চোখ ফিরিয়েছিল। তাকানোটা খুব সুবিধের মনে হয়নি। সেই সঙ্গে মুনাইও বেরিয়ে এসেছিল ওদের ঘর থেকে। সে যেন কিছু-একটা বলার জন্য প্রস্তুত হয়েই এদিকে আসছিল। এরপর যদি বদরাগী শান্তিলাল যোগ দেয়, তাহলে চরম অশান্তি হবে। এমনিতে ভাইয়ের কথা শুনে গুম মেরে ছিল লোকটা। তাই ব্যাপারটা সহজ করার জন্য বিলাসী বলেছিল,
এক কাজ করো না ঠাকুরপো, তোমার শাশুড়িকে বরং এখানে এনে রাখো। তোমাদের পাশের ঘরেই উনি থাকতে পারবেন।
মেয়ের বাড়ি এসে থাকতে রাজি হবেন না উনি। জবাব দিয়েছিল বাবুলাল।
তাহলে তুমি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থাকতে রাজি হলে কেন? সবকিছু ঠিক করার আগে তো পরামর্শ করোনি তোমার দাদার সঙ্গে? সিদ্ধান্ত নিয়ে তারপর জানিয়েছ! কথাগুলো পেটের মধ্যে গুড়গুড় করলেও বলতে পারেনি বিলাসী। কিছু না-বলেই চলে গিয়েছিল নিজেদের ঘরে। ‘মায়ের জন্য কিছু কিছু টাকা দেবো দাদার হাতে।’ কথাটা চলে-যাওয়া বিলাসীর দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল বাবুলাল। যেন দাদাকে নয়, বৌদিকেই জানানো দরকার ছিল। বিলাসী পিছন ফিরে দেখারও চেষ্টা করেনি তার দিকে।
কড়াইতে লতি-চিংড়ি নাড়তে নাড়তে বিড়বিড় করে বিলাসী, মাস খানেক পরে সেই যে দুশো টাকা ঠেকাল দাদার হাতে, তারপর থেকে আর এক টাকাও তো গলল না হাত দিয়ে! খুন্তি দিয়ে লতি-চিংড়ি নয়, যেন কথাগুলোই নাড়াচাড়া করে সে। হলুদ কি কম পড়ল? কেমন সাদা সাদা লাগছে না? ভাবতে ভাবতে সামান্য হলুদ ছিটিয়ে দিল। আর এক চিমটে চিনি। সামান্য চিনি দিলে রান্নায় স্বাদ হয় বেশ। লংকা বাটা বেশি করে দিয়ে নাড়তে থাকে আর কান খোলা রাখে সে। কিন্তু রান্নার শব্দ ছাপিয়ে মায়ের ঘর থেকে কোনও শব্দ ভেসে আসে না। হতাশ বিলাসী রান্নায় মন দেয়।
* * * *
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে বারান্দায় মাদুর পেতে বসেছে বাবুলাল। নিজেই ঘর থেকে মাদুর নিয়ে এসেছে। দাদাকেও ডেকে বসিয়েছে।
সন্ধ্যায় তো চলেই যাব। এসো বৌদি, একটু গল্পগাছা করি।
সহসা বিলাসীর মনে একটা ভালো লাগার বাতাস খেলে যায়। খেতে বসে বাবুলাল তার রান্নার প্রশংসা করেছিল অনেক। লতি-চিংড়ির ঝাল চেয়েও নিয়েছিল একবার। মুনাইয়ের আবার চালতার চাটনি বেশি ভালো লেগেছিল। এই প্রশংসা বিলাসীর মনে আনন্দের দোলা দিয়েছিল। তার উপর বাবুলালের ছোট্ট মেয়ে পুচুকে মুনাই ঠেলে দিয়েছিল বিলাসীর কাছে। দুই ভাই খেতে বসার আগেই মেয়েকে খাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। তখনই মুনাই বলেছিল,
রোজই তো আমিই খাওয়াই। আজ তুই জ্যেঠির হাতে খেয়ে নে। দেখিস তোর জ্যেঠি কী সুন্দর করে খাইয়ে দেবে। অনেক গল্প বলবে। আমি বরং আজ মাকে খাইয়ে দিই। খুশিতে নেচে উঠেছিল
নিঃসন্তান বিলাসী। রাক্ষস-খোক্কসের গল্প বলে পুচুকে খাইয়ে দিয়েছিল সে। বিস্ফারিত চোখে জ্যেঠির গল্প শুনতে শুনতে খেয়ে নিয়েছিল পুচু। মুনাই শাশুড়িকে ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছে। এই কাজটা বিলাসীকেই প্রতিদিন করতে হয়। বুড়ি অবশ্য তেমন গাঁইগুঁই করে না। ভাত খেয়ে নেয় দিব্বি। মগে করে জল নিয়ে মুখ ধুইয়ে, গ্লাশভরা জল মুখের কাছে ধরলেই চোঁ করে টেনে নেয় ফোকলা মুখে। তবু এই কাজটায় বেশ বিরক্তি ধরে বিলাসীর। বাচ্চাদের মতো সারা মুখ ভরে যায় এঁটোতে। সেসব পরিষ্কার করতে হয়। গা-টা প্রতিদিনই গুলিয়ে ওঠে। আজ মুনাই দায়িত্ব নেওয়ায় আনন্দ হয়েছিল খুব। অন্তত একটা দিন তো এই গা গোলানোর থেকে রেহাই পেল সে!
শান্তিলাল মাদুরে গা এলিয়ে শুয়ে আছে তখন। কিছুক্ষণ বাদেই মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে ওদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে মুনাই। এসে বসেছে মাদুরের এক প্রান্তে। তারপর বাবুলালের দিকে তাকিয়ে বলে, কী বলবে বলছিলে তখন, বলো না দাদাকে।
ঘাড় উঁচু করে তাকায় শান্তিলাল।
কী বলবি রে ভাই?
ইতস্তত ভাবে বাবুলাল বলে,
বলছিলাম কি, আমরা তো থাকিই না এ বাড়িতে। তাই ভাবছিলাম ঘরটা ভাড়া দিয়ে দেবো। এক দিদিমণিকে পেয়েছি। নতুন চাকরি পেয়েছে বিনোদিনী গার্লস স্কুলে। ছোট্ট ফ্যামিলি। আমি মাসে মাসে এসে ভাড়াটা নিয়ে যাব। আগামী মাসে থেকেই ভাড়ায় আসবে দিদিমণি।
শান্তিলাল তড়াক করে উঠে বসে। ভাইয়ের মুখের দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে সে।
আর টিভির কথাটা বলো! মনে করিয়ে দেয় মুনাই।
ওটা তুমিই বুঝিয়ে বলো। অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলে বাবুলাল। শান্তিলাল আর বিলাসীর চোখ ঘুরে যায় মুনাইয়ের দিকে।
টিভিটা পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে ঘরে। ওটা লোকনাথ টিভির দোকানে দিয়ে এক্সচেঞ্জ করে একটা একটা এলইডি নেব ও বাড়ির জন্য। কথা হয়েছে দোকানদারের সঙ্গে। সামনের মাসে এসে পুচাইয়ের বাবা দোকানে নিয়ে যাবে টিভিটা।
শান্তিলাল একবার মুনাই আর একবার বাবুলালের দিকে চোখ রাখে। তারপর মাদুরেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। চোখ বোজা হলেও হতাশা ধরা পড়ে তার মুখের রেখায়। বিলাসীর হঠাৎই গা গুলিয়ে ওঠে। মায়ের খোঁজখবর নয়, নিজেদের কাজেই এসেছিল! তাহলে পুচাইকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য এগিয়ে দেওয়া, রান্নার প্রশংসা, মাদুর পেতে গ্লপগাছা করার কথা বলা, সবই নাটক! ভাবে বিলাসী।
লতি-চিংড়ির ঝাল বিলাসীর গলার কাছে আটকে থাকে যেন। ঝাল নয়, মুখটা তার তিতো হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গেই। লতি-চিংড়ির ঝাল কিভাবে তেতোয় পরিণত হল, বোঝার চেষ্টা করে সে। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে বাবুলাল আর মুনাইয়ের দিকে।
জন্ম কলকাতার কালীঘাটে। অতি শৈশবেই নদীয়া জেলার কল্যাণী শহরের উপকণ্ঠে বসবাস শুরু। কবিতা, ছোটগল্প, অণুগল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। লিটল ম্যাগাজিন ও বাণিজ্যিক পত্রিকায় এবং অন্তর্জালেও নিয়মিত লেখালেখি করেন।পুরস্কার ও সম্মাননাঃ (১) কলম সাহিত্য সম্মান, ২০১৭। (২) সুতরাং সাহিত্য পুরস্কার, ২০১৭। (৩) চাতক সাহিত্য সংস্থার টেগোর ভিলেজ পুরস্কার, ২০১৭। (৪) অবগুন্ঠন অণুগল্প সম্মান, ২০১৯।
full-width
Continue Reading

গল্প

ভোর আর সমুদ্র মিলেমিশে একাকার…হঠাৎ বাজে সেলফোন…হাওয়া আর সাগরের ছন্দে বেমানান হয়ে ওঠে রিংটোন

Published

on

পরিযায়ী

মানস সরকার

        পেয়েছি…
        মৌলীর গলায় বাড়তি আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া। সেলটা ডেস্কের উপর রেখে লাউডস্পিকারটা অন্‌ করল সপ্তর্ষি। আর দু’ঘন্টা বাদেই প্রেজেন্টশ্‌ন,গ্রুপ প্রোডাক্ট ম্যানেজারের ঘরে। ল্যাপটপে সতর্ক চোখের সাথে কি-বোর্ডেও আঙুলকে ব্যস্ত রাখতে চাইল সপ্তর্ষি। আগের কনফারেন্সে অরনিডাজলের মলিকিউলটার নামের ব্যাপারে কথা উঠেছিল। এবারে সেটুকু খামতিও রাখবে না। নিফাডল না নিডল – কোম্পানীর আদ্য অক্ষর ব্যবহার করে প্রোডাক্টের নাম রাখাটা বেশি ক্যাচি। চিন্তা পাক দিয়ে ওঠে ভেতরে……
        একটু পরে করব কি!
        ঘড়ির কাঁটা বাড়তি ঘুরতেই মৌলীর গলায় উত্তাপের পরশ।
        সপ্তর্ষি ব্যস্ততার খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করে। মৌলী ওর অফিস স্টাফ নয়। ছ’মাসের বিয়ে করা বউ।
        না, না, বলো।
        বলছি, জায়গাটার নাম বের করেছি।
        মনে পড়েছে সপ্তর্ষির। কাছে পিঠে একটা সি স্পট খোঁজার কথা হচ্ছিল কাল রাতে খেতে বসে। সি স্পটটা অবশ্য মৌলীর ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়েই। নইলে সপ্তর্ষির পাহাড়কেই বেশি রহস্যময় মনে হয়। মন্দারমণি বা দীঘায় বেশ কয়েকবার কনফারেন্সে গেছে। লোকজনের ভিড়ে জায়গাগুলোয় এখন সারা বছরই মেলা লেগে থাকে। গোপালপুরটা একটু ফাঁকা পাওয়া যায়। কিন্তুু ওড়িশার যে কোনও জায়গাতেই দু’তিন দিনের বেশি লেগে যাবে। সেটা আবার সপ্তর্ষির পক্ষে বেশ শক্ত। ওয়ার্ক প্রেসার এখন মারাত্মক জায়গায়। তিনমাসের মধ্যেই কোম্পানী চারটে নতুন প্রডাক্ট লঞ্চ করতে চলেছে। বিয়ের পর ছ’ছটা মাস কেটে গেলেও মৌলীকে নিয়ে সেভাবে কোথাও ঘুরে আসতে পারেনি। মধুচন্দ্রিমার মধু’র স্বাদ চিনির দানায় মিটিয়েছে ওদের নিজেদের হরিশ পার্কের ফ্ল্যাটে।
        বল…
        দীঘা বা পুরীর নামটা শোনার অপেক্ষায় রইল সপ্তর্ষি।
        বকখালি।
        কী!
        বকখালি।
        গ্রেট। ডায়েরিতে সম্রাট ট্রাভেলস’এর ফোন নাম্বার আছে। হোটেলটা বুক করে ফ্যালো।
ও প্রান্ত চুপ। এ প্রান্তে তখন আরও দ্রুত আঙুল চলছে কি-বোর্ডে। পলকে থামে সে আঙুল। প্রায় যন্ত্রের মতো নড়ে ওঠে নিফার ইন্ডিয়া প্রডাক্ট এক্সিকিউটিভের ঠোঁট।
        দিন দু’য়েকের বেশি যেন বুকিং কোর না।
        ও প্রান্ত এখনও চুপ। লাউডস্পিকার দিয়ে দীর্ঘশ্বাসের ঝড় ভেসে আসে। ফোনটা কেটে যাওয়ার আওয়াজ শোনা যায়। এক মুহুর্তের জন্য কি-বোর্ডে চলতে থাকা আঙুল শ্লথ হয়। তারপরই যেন ঘোর কাটিয়ে হাতে আরও গতি আসে। ভয়াভহ গতি। ঝড়ের গতি। যন্ত্রকেও হারিয়ে দেওয়ার। সব কিছুকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার গতি। আর ক্রমশ একা হতে থাকার সমীকরণ……
                                                                         (২)
         গিয়ারে পড়তেই গাড়ি যেন পক্ষীরাজ। ডায়মন্ড হারবার রোডের দু’ধারে অসংখ্য দোকান। তারই একটাতে গাড়ি থামিয়েছিল সপ্তর্ষি। সকালে দু-দুবার চা খাওয়াটা অভ্যেস। হোস্টেল থেকেই। প্রথমবারের চা’টা ফ্ল্যাটেই খেয়েছিল, সকালে। এখানে দ্বিতীয়বারের চায়ের সাথে ব্রেকফাস্টটাও সেরে নিল, দু’জনে। মৌলী আপত্তি তুলেছিল। শোনেনি সপ্তর্ষি। কাকদ্বীপ পৌঁছতেই এগারোটা বেজে যাবে। ওখান থেকে নামখানা। মধ্যিখানে কোথাও থামার ইচ্ছে নেই।
        অল্টোটা সপ্তর্ষি নিয়েছে বিয়ের আগেই। ড্রাইভার হিসেবে অনেকের কাছ থেকেই প্রশংসা কুড়িয়েছে। তারমধ্যে মৌলী একজন। ব্যান্ডেল থেকে, মাঝেমধ্যেই ভেসে আসে মায়ের সাবধানবাণী, ‘সাবধানে চালাবি কিন্তুু।’ গাড়ি নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে শুনেই মৌলীকে উপদেশের একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। কলকাতায় এসে থাকলেও মা যে ব্যান্ডেলের বাড়িতেই বেশি থাকতে চায়, এটা বোঝে সপ্তর্ষি। বাবার স্মৃতি একটা কারণ। মাঝে মধ্যে মায়ের জন্য যে চিন্তা হয় না, তা নয়। কিন্তু চিন্তাটা লাঘব করেছে মিনতি মাসি। মা’এর সঙ্গে শুধু থাকে, তাই নয়। মা’কে নিজের দিদির থেকেও বেশি কিছু দেখে। গড় গড় করে কেরিয়ারের পথে এগোতে নিজেকে বাধাহীন লাগে।
        সপ্তর্ষির পাশেই বসেছে মৌলী। পিছনের সিটে মালপত্র। লাগেজের পরিমাণটাও একটু বেশি মনে হচ্ছে। সপ্তর্ষি কিছু বলেনি। ট্রিপটা হনিমুনই। রাতেও দু’একটা পোশাক ভাঁজ করতে করতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল মৌলী
        দ্যাখো না, এই ইমপেরিয়াল ব্লু সালোয়ারটায় আমাকে ভাল লাগবে?
        সামনের খোলা ফাইলটা থেকে মুখ না তুলেই সপ্তর্ষি জবাব দিয়েছিল,
        হুঁ। ভীষণ।
        মুখের উপর ছুঁড়ে মৌলী সালোয়ারটা মারতেই বোধগম্য হয়েছে, রংটা আসলে অফ হোয়াইট ছিল। মৌলী এরকমই। নিউআলিপুরের মেয়ে। ওর বোন বলে
        দিদি কুছ খাট্টি, কুছ মিঠি।
        খাট্টা স্বাদ পেয়েছে সপ্তর্ষি। মিঠার তেষ্টাটা গলায় যেন আটকে। চুল অল্প অল্প উড়ছে মৌলীর। কাঁচ নামিয়ে রেখেছে দু’জনেই। সূর্যের আলো চুলেতে বাদামি রঙের স্যাডো তৈরি করছে। ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।’ চুলের আশ্রয়েই কি সব কবির হাজার বছরের হাঁটা শেষ হয়! সপ্তর্ষির হাঁটাটা ঠিক কত বছরের……. একটু রোমান্টিক হবার চেষ্টা করল।
        মৌ, ওখানে গিয়ে জিনসটা একটু পোরো। হ্যান্ডিক্যামটা দিয়ে একটু শুট করব।
        হুঁ, অন্যমনস্ক গলা মৌলীর।
        কালারটা ডেনিম না?
        হ্যাঁ, তোমারটাও নিয়েছি।
        হেসে ফেলে সপ্তর্ষি। বলে
        ভুঁড়িটা দেখেছ।
        সপ্তর্ষির হাসি মৌলীর মুখেও ছড়িয়ে পড়েছে। গালের টোলগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। হাওয়াটা মিষ্টি হয়ে আসছে। মধুচন্দ্রিমার মধু জমে উঠছে কি………..
        সেল বাজছে। আওয়াজটা কর্কশ। রাস্তার একপাশে গাড়িটা দাঁড় করাল সপ্তর্ষি। ফোন অন করতেই গলাটা যেন মুহূর্তেই ওকে গিলে ফেলল। মিঃ নটরাজন। জি.এম., মার্কেটিং।
        হেলো, ক্যান আই স্পিক টু সপ্তর্ষি বাসু, প্লিজ?
        মর্নিং স্যর, সপ্তর্ষি রিপোটিং ফ্রম কলকাতা…
        মর্নিং বাসু।
        অল্প থেমে প্রশ্ন করেন মিঃ নটরাজন
        উইল য়্যু ফেভার মি এ্যা থিং?
        মৌলীর দিকে তাকিয়ে একবার ঠোঁটটা চেটে নেয় সপ্তর্ষি।
 
মাথা নিচু করে বসে আছে।সপ্তর্ষি বলে,
        সিওর স্যর।
        দেন সেন্ড দ্য প্রিভিয়াস অরনিডাজল প্রডাক্ট পোর্টফলিও ওভার মাই ফ্যাক্স নাম্বার।
        বাট্‌ স্যর, দ্য ফাইল ইস অলরেডি উইথ মিঃ আচারইয়া।
        অ্যারেঞ্জ সামথিং।
        বাট্‌……
        লাইন কেটে গেছে।
        সান্‌ অফ অ্যা……
        সপ্তর্ষি গুম মেরে যায়।
        নিস্তব্ধতাকে সরিয়ে রেখে মৌলী ঝলমল করে ওঠে। বলে,
গাড়ি ঘোরাবে না কি?উত্তর দেয় না সপ্তর্ষি। কিছু একটা…… কিছু একটা…… ফোনবুকে মিঃ আচার্যর নাম্বারটা খুঁজে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
        বকখালি পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। অথচ দুপুরের মধ্যেই ঢুকে যাবে ভেবেছিল সপ্তর্ষি। অনেক চেষ্টায় মিঃ আচার্যর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে। কনভিন্স করে, প্রডাক্ট পোর্টফলিওটা মিঃ আচার্যকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতেও পেরেছে। কিন্তু এখনও একটা ফ্যাক্স পাঠাতে হবে। হোটেলে মৌলীকে ঢুকিয়ে দিয়ে ফ্যাক্স সেন্টার খুঁজতে বেরোল। বকখালিতে পাওয়ার অফ হওয়ার বিচ্ছিরি প্রথা আছে। ভাগ্যক্রমে সব ম্যানেজ করে ফেলতে পারল। তখন সব কিছুকে ঘিরে নেমে আসছে সন্ধের অন্ধকার।
        রুমের কলিংবেল দিতে আধমিনিটের মধ্যেই দরজা খুলল মৌলী। চান করে পিঠে ছড়িয়ে দিয়েছে একরাশ চুল। সালোয়ার ছেড়ে ম্যাক্সি গলিয়েছে। ম্লান হেসে ঘরে ঢুকল সপ্তর্ষি। মৌলী বোধহয় বুঝেই গেছে, আজ আর কোথাও যাওয়া হবে না। ক্ষিদে ক্ষিদে পাচ্ছিল। পথে লাঞ্চটাও ঠিক করে করা হয়নি। রুম সার্ভিসকে ফোন করে খাবার অর্ডার দিল। তারপর চান করতে ঢুকল। সারাদিনের ধকল কাটাতে চান আর ঘুমের বিকল্প নেই।
        বাথরুম থেকে বেরতেই অবাক সপ্তর্ষি। এসি চলছে। টিভিও। রুম সার্ভিস খাবারটাও দিয়ে গেছে। মৌলীকে দেখতে পেল না। গায়ে তোয়ালেটা জড়িয়ে খাটের পাশের দরজাটা খুলে জমাট অন্ধকারের মধ্যে ব্যালকনিতে মৌলীকে আবিস্কার করল। একটু ঝুকে রেলিঙে সাপোর্ট রেখে দূরের আলো-আধাঁরিতে তাকিয়ে আছে। পিঠে সপ্তর্ষি হাত রাখতেই একটু শক্ত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সপ্তর্ষির হাত মৌলীর চুল, চুল থেকে গালে চলে যায়। চমকে ওঠে সপ্তর্ষি। ওর চোখ, গাল ভেজা। এখনও জল নেমে আসছে গরম কিন্তুু ভীষণ নরম। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। মৌলী এই ছ’মাসে যা বলেনি, সেসব শব্দ নিজের ভেতর শুনতে পাচ্ছে। ভেতরের অনেক গতিকে থামিয়ে শব্দগুলো সপ্তর্ষিকে স্তব্ধ, শান্ত করে তুলছিল। আর ফ্যাল ফ্যাল করে ওদের দু’জনের দিকে তাকিয়েছিল অন্ধকার। খুব সকালেই ঘুমটা ভেঙে গেল সপ্তর্ষির। ঘরের এসি অফ্। তার মানে মৌলী ভোররাতে উঠেছিল। তখনই অফ করেছে। এখন পাশে শুয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে। ঘর এখনও বেশ ঠান্ডা।
        কাল রাতে খাওয়া দাওয়ার পর বেশ আড্ডার মুডে এসেছিল ওরা দু’জনে। আর একটু বেশি সাহচর্য কি মৌলী চাইছিল! সপ্তর্ষির মন খারাপ হয়ে গেল। কথা বলতে বলতেই চোখ যেন বুজে আসছিল। আসার আগের দিনও অনেক রাত ওবধি জেগে কাজ করেছিল। মাত্র দু’টো দিনের ছুটিতে আসার জন্য যা কাজ করতে হয়েছে, ভাবা যায় না। সামনের বছরেই কলকাতা অফিস থেকে একজনকে অন্তত হেডঅফিসে প্রমোশন দিয়ে নিয়ে যাবে হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলমেন্ট। সেই একজনটা ওকেই হতে হবে। এমনটাই ভেবে রেখেছে। মুখ বুজে তাই ওয়ার্কলোডটা নিয়ে যাচ্ছে। সবথেকে বড় কথা, এই গ্রাউন্ডে হেড অফিসের কাউকে ও চটাতে চায় না।
        একটু অলস লাগছে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। তাও উঠল। হোটেলে পড়ে থাকবে বলে নিশ্চই ছুটি নেয়নি। চারপাশটা ঘুরে দেখার লোভ কাজ করছে ওর মধ্যে। একটু ঘুরে আসা বালুকা বেলায়। বকখালির সাগর শুনেছে শুন শান। মগ্ন থাকে অন্য ধ্যানে। জানলার পর্দা সরাতেই কাঁচের ওপাশের স্নিগ্ধতা সপ্তর্ষিকে কাছে ডাকে। পায়ে পায়ে বেড়িয়ে পড়ার এক অদৃশ্য ইঙ্গিত ছুঁয়ে যায়। পিছন ফিরে মৌলীকে ভাল করে দেখে সপ্তর্ষি। সাগরের স্নিগ্ধতা আর মাধুর্যতা ওর চোখে মুখে ছড়িয়ে। বিয়ের ছ’মাসে এই প্রথম মৌলীকে এত নির্জনে। অবিন্যস্ত চুল গালে, কপালে। প্রেমের ওম। ডেকে তুলবে? হেঁটে যাবে কি একবার দু’জনে নীল নির্জনে? পারল না…… ভীষণ মায়া হচ্ছে মৌলীকে দেখে। মনে হচ্ছে, ভোরের সুখ স্বপ্নে আচ্ছন্ন। তাছাড়া রোজই তো প্রায় সকালেই ওঠে। ওর অফিস, রান্না, টিফিন। সকালের চা’টা ওবধি সপ্তর্ষি বিছানায় পেয়ে যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে বাইরেটা বড় টানছে……
        দরজাটা ভেজিয়ে বেরিয়ে আসার সময় একটু অনিশ্চিত লাগল। রিসেপশনে নেমে অবাক সপ্তর্ষি। আগের দিনের ছেলেটি একমুখ হেসে ওকে গুড মর্নিং জানায়। হেসে দাঁড়িয়ে পড়ে সপ্তর্ষি। ছেলেটি জানতে চায়
        সানরাইস স্যর?
        ঘাড় নেড়ে সপ্তর্ষি বলে
        ম্যাম থাকলেন।
        চিন্তা করবেন না। আপনি ঘুরে আসুন।
        এত সকালে কলকাতায় কোনওদিন ওঠে না। ট্যুরে যাবার জন্য তাড়াতাড়ি উঠলেও এত ভোরে ওঠা হয় না। হাঁটছে। বালুরাশি মাড়িয়ে নতুন পৃথিবীতে প্রবেশ করছে। ভোরের গন্ধের সাথে সমুদ্রগন্ধ মিলেমিশে একাকার। সাগরের খুব কাছে চলে আসে। বাতাসের বওয়া আর ঢেউ’এর আছড়ে পড়ার মধ্যে মুক্তির গন্ধ পাচ্ছে। এমনকি আঁশটানি গন্ধটাও প্রকৃতির বড় নিজস্ব। তাই মোটেও বেমানান নয়। দূরের ঝাউবীথি ভোরের বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে। প্রমোশনের লোভে নয়। সপ্তর্ষিকে যেমন হামেশাই দোলাতে হয়।
        আশেপাশে কাউকে তেমন নজরে পড়ল না। সাগরের বেশ কিছুটা দূরে দু’টো কালো বিন্দু। নিশ্চই মাছ ধরার নৌকো। আকাশ এখনও সোনালি আবির মাখেনি। বেশ কিছুটা এগিয়ে এসে থামে সপ্তর্ষি। আশেপাশে তাকায়। কিছু দূর দূর অন্তর সিমেন্টের বেঞ্চ করে রেখেছে ট্যুরিজম কর্তৃপক্ষ । একটাতে বসে। টিশার্টটা পত্‌ পত্‌ করে উড়ছে। মাথার চুল বাতাসের সঙ্গেই ডানা মেলতে চাইছে। সৃষ্টির আদিতে চলে যাওয়া। মাথার উপরে আওয়াজ্‌ হতে চোখ তুলে তাকাল সপ্তর্ষি। দু’টো পরিযায়ী পাখি। নিজেদের মধ্যে অদ্ভুত খুনসুটির খেলায় মেতেছে। প্রেমের নিজস্বতা না কি এরকম পরিবেশেই প্রেম মুক্তি পায়। নিজের আকার নিয়ে গড়ে উঠতে থাকে।
        গোটা পরিবেশটাকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে হঠাৎই বেজে ওঠে সপ্তর্ষির সেলফোন। পরিযায়ী পাখি দু’ট সরে যাচ্ছে দৃষ্টি থেকে। পকেট থেকে ফোনটা মুঠোয় আনতে স্ক্রিণে মিঃ নটরাজনের নাম্বারটা নজরে আসে। হাওয়া আর সাগরের ছন্দে বেমানান হয়ে উঠতে থাকে রিংটোনটা। চোয়াল দু’টো শক্ত হয়ে আসে সপ্তর্ষির।
        পরিযায়ী পাখি দু’টো সপ্তর্ষির দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে। বেজেই যায় ফোন। দূরে হেঁটে আসতে থাকা মৌলী তখন ক্রমশই কাছে…..

 

Continue Reading

গল্প

উলঙ্গ রাজার শরীরে পোকা সে দেখেও দেখে না

Published

on

চন্দন চক্রবর্তী

জুজু 

বছর তিনেক হল এই আবাসনে এসেছি৷ ভীষণ সুন্দর৷ বারোতলা করে বিল্ডিং৷ সাতটা ব্লক৷ আমি ‘বি’ ব্লকে থাকি৷ করোনার প্রকোপে বাড়ি থেকে অফিস বন্ধ,ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে৷ লকডাউনেও রোগটা বেশ ছড়িয়ে পরেছে৷ নীচে বিশেষ নামা যাচ্ছেনা৷ তাই বারতলার টেরাসে এসেছিলাম৷ একটু পায়চারি করার উদ্দেশ্যে৷ উফ কী সুন্দর আামার শহর৷ অনেক আলোর ঘরবাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে৷ সবার মাথায় চেপে বসে আমি৷ সাঁঝবেলায় অন্ধকারে এক অপূর্ব মাধুর্য জড়ানো থাকে৷ সেটা জড়িয়ে শহর দেখছিলাম৷ কোনও দিন এভাবে একা শহর দেখা হয় নি৷ আজ সেই সময় সুযোগ পেলাম৷
              হঠাৎ কে যেন আমার পাশে বসে পড়ল৷ আমি বুঝতে পারছি কেউ বসল৷ কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা৷
             ও বলল,‘কাকে খুঁজছো?আমাকে?’
             আমি একজন সাংবাদিক এবং একটি নামি বাংলা দৈনিকের সম্পাদকও বটে৷ প্রেসিডেন্সি থেকে মাস্টারস করে সাংবাদিকতা শুরু করি৷ এখন সম্পাদক৷ সুতরাং অনেক কিছু দেখা৷ কিন্তু এরকম কখনও দেখিনি কেউ পাশে এসে বসল অথচ সে দৃশ্যমান নয়৷ ভূত প্রেত এর নাম শুনেছি কিন্তু একেবারেই বিশ্বাস করিনা৷ হ্যাঁ, উপনিষদের আত্মা-তত্ত্ব মানলে আাত্মা বিদ্যমান কিন্তু দেখা যায় না৷ কাঠের মধ্যে অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো৷ তাহলে এটা কি কারও আত্মা৷ ব্যাটা ছাদে আমাকে একা পেয়ে গেঁড়ে বসেছে৷কার আত্মা? কে সে? দেখা যাক ব্যাটা কী বলতে চায়৷
              ‘তোমাকে খুঁজতে যাব কেন? তোমার তো অস্তিত্বই নেই৷ যাই হোক এসেই পড়েছ যখন তখন বলে ফ্যালো  তুমি কে? কেনই বা এসেছ? আমার মাথাটা একটু হাল্কা করতে দাও৷ কালকের পেপারের কিছু কাজ এখনও রয়ে গেছে,যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷
              ধরোনা কেন তোমাকে সেই ব্যাপারেও সাহায্য করতে পারি৷
              সময় নষ্ট না করে বলো তুমি কে?
              আমি দৃশ্যমান নই তবুও ছোট্টবেলা, মাঝবেলা,বুড়োবেলাতেই আমি থাকি৷ আমার নাম করে তোমাদের ভয় দেখাত৷ আর এখন এই বয়সে সত্যিই ভয় দেখাই৷
             কে হতে পারে ! এতো দেখি মেমরি গেমে ফেলে দিল৷তবে বেশ মজা পেলাম৷ ছোট্টবেলায় খেতে না চাইলে বা ঘুমোতে না চাইলে মা বলতো ‘ওই হাম্বা আসছে’ অথচ তখন হাম্বা বলে কিছু চিনতাম না৷
             ইতস্তত করে বলি,‘তুমি কি হাম্বা নাকি?’
             ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসে৷
             ‘যা বাবা শেষে হাম্বা!’
             ‘ভাবো,ভাবো,ভাবতে থাকো৷
             ‘শোন আমার ভেবে কাজ নেই৷ আমার বলে চাকরির চিন্তায় মরছি৷ তুমি ফুটে যাও৷’
             ‘কী ভাবছ? চাকরি চলে যাবে? এই করোনা পিরিয়ডে দেশের ইকোনমি তলানিতে৷ সুতরাং কর্মী ছাঁটাই চলবে৷মাইনে কমিয়ে দেবে ইত্যাদি তাইতো!’
             কিছুটা বমকে গেলাম৷ ব্যাটা বলে কি?
             কিছুটা তো ঠিক৷ কিন্তু খবরের কাগজ চালানো দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে৷এভাবে চলতে পারে না৷
            লোকটার গলার স্বর গাড় হল৷ কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা মনে হতে লাগল৷ অথচ আমি পোড় খাওয়া একজন সাংবাদিক কেমন ভেতর ভেতরে ঘাবড়ে গেলাম৷
            আমোঘ বাণী শোনাবার মতো করে বলল,
            ‘চালাতে হবে, মালিক যা চাইবে তাই করতে হবে… না হলে ছোটবেলার সে এসে ঘাড়ে চাপবে৷ ছেলেপুলে নিয়ে সংসার করো, কী লাভ ওসব করে?’
            তা বলে সংবাদ মাধ্যমের বা সাংবাদিকের নীতি আর্দশ? সব সমালোচনা করাই তো আমাদের মৌলিকতম কর্তব্য! আরে বাবা গনতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে কথা৷সরকারের নেতাদের ভুলত্রুটি তুলে ধরা থেকে সরে আসা যায়?
           ‘ধুত তেরি!এতো দেখি একেবারে আবোধা! নিজের ভালো নিজে বোঝেনা?’
            শোন ‘কুর্শিকে কখনও প্রশ্ন করতে যেওনা৷ তাকে কুর্নিশ করতে শেখো৷ না হলে, কিন্তু যতই ক্ষমতাবান লেখক,কবি,সাংবাদিক হওনা কেন, এমন কেসে ফাঁসাবে বাপ্ বলার সুযোগ পাবেনা৷ সোজা ফাটকে!
           ‘তাই বুঝি, দেশে কি আইন কানুন নেই নাকি?
            আবার ফ্যাক ফ্যাক হাসি৷ হাসির শব্দটা কানে ঢুকে সমস্ত শিরা উপশিরা ধরে মাথায় চলে যাচ্ছে হাসিতেও কেমন এক বদ গন্ধ, শরীরে পাক মারছে সেই পুতি গন্ধ!
           এবারে হাসি থামিয়ে অদৃশ্য মানুষটি বলে,‘আইনকেও প্রশ্ন করোনা৷ দিনকাল খারাপ৷’
           বুঝলাম,তা কী করতে হবে?
          এসো, পথে এসো, ঘরে গিয়ে কাগজের হেডিংগুলো পরিবর্তন করো৷ যেগুলো ক্ষিতকারক অথচ বড়   হরপে দেওয়ার কথা সেগুলো চেপে যাও৷ নতুবা, ছোট্ট করে শেষের দিকে কোথাও গুঁজে দাও৷ মোদ্দাকথা প্রো-সরকার কথাবার্ত্তা লেখ৷ দরকার হলে গলায় ঘন্টি বেঁধে তা বাজাও৷ না হলে কিন্তু…’
          শালা!তুমি কি সুপারি কিলার নাকি? কত সুপারি পেয়েছিস, ব্যাটা ?বললে,‘তোমার বাড়িতে বহু সুপারি চলে যাবে৷ পায়ের ওপর পা তুলে খাবে৷ দশবার বিদেশে কাজে অকাজে যাবো৷ জীবন রঙিন হয়ে যাবে৷’
          শরীর থির থির করে কাঁপতে থাকে৷লোকটি কে সামনে আসছেনা কেন? পরিচয়ও দিচ্ছেনা৷ কে পাঠিয়েছে? বেশ কিছুক্ষণ ওর শব্দ নেই৷ স্ল্যাবে বসে ছিলাম৷ উঠে আধো অন্ধকারেই খুজতে থাকি৷ ওপাশে একটা ঢাকা অংশ আছে৷ বিস্তর ময়লা জমেছে৷ ওখানেই কি গা ঢাকা দিল৷ এখন তো মনে হচ্ছে না, ব্যাটা আমার সঙ্গে আছে৷ যাকেগে্ বাঁচা গেছে৷ তবে এটুকু মনে আছে রাজা যখন কলকাতায় এসে সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন তখন হাততালির বন্যায় ভেসে যাচ্ছিলেন৷ তখন মনে মনে উচ্চৈস্বরে প্রশ্ন করেছিলাম কবির ভাষায় ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ সেটা কীভাবে রাজা শুনেছিলেন জানিনা৷ শুধু বলেছিলেন ‘প্রশ্ন করা যাবেনা’৷
         সেই ভেতর প্রশ্ন আমাকে এখন তাড়া করে বেড়ায়৷ যেই কুর্শিতে বসুক৷ যত সুন্দর তা হোকনা কেন সব সময় মনে হয় রাজা উলঙ্গ৷ তার শরীরে সজস্র পোকা কিলবিল করে ঘুরছে৷ সে দেখেও দেখেনা৷ বুঝেও বোঝেনা৷ আবোধার মতো হাসে৷ সেই বোধ কলমে বেরিয়ে আসে৷ কিন্তু একা কি পারবে এই নকল বুধি গড়কে রক্ষা করতে৷
         যাকগে, এসব ভেবে লাভ নেই, হয়তো ভুলভাল ভেবে চলেছিলাম৷ অথবা রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীদের হয়ে কাজ করবার মানসিকতা আমার ভিতর মনে ঢুকে যাচ্ছে৷ আর সেটাই চেতন মনে জ্বালাতন করছে৷
         ছাদের প্যারাপিটের কাছে দাঁড়াই৷ উফ্, কত সুন্দর কলকাতা! অথচ এই সুন্দরের মধ্যে কত কীট! কলকাতাকে কুরে কুরে খাচ্ছে৷ তাদের কাজই ধ্বংসাত্মক৷ কিন্তু তাদেরও তো খাদ্যের প্রয়োজন! তবে যে  লোকটা এসেছিল সে কি আমাকে ‘খাদ্য’ ঠাউরেছে! সর্ম্পকটা কি তবে খাদ্য এবং খাদকের৷ খাওয়ার আগে কিছু জ্ঞান দিয়ে দিল৷ যেমন যুদ্ধের আগে এক ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ হুমকি খেলা! ওই একটা হুমকিতে দেশের মানুষকে বশ করা যাবে!
          লোকটি, কি আছে? নাকি ভেগেছে? কিন্তু জানা হলোনা ওর আসল পরিচয়টা কী?
           দু’বার পায়চারি করলাম৷ বেশ ভালো লাগছে৷ মাথার উপর আকাশটা কত কাছে৷ রূপোলি আলোয় আলোময়৷ তারা ঝিকমিক৷ কোন গ্রহে এখনও প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায়নি৷ ভাগ্যিস, মানুষের মতো কোন প্রাণী জন্মায়নি৷ নিজেদের আধিপত্য বজায় করার জন্য ‘ভাইরাস’ যুদ্ধ ভাবা যায়৷ বাহ এখান থেকে নীচের পথ ঘাট গাছপালাও কত দূরে৷ আমি যেন মাঝে দাঁড়িয়ে৷ যেখানে খুশি চলে যেতে পারি৷ কিন্তু চিন্তার আবার লোকটা এসে পড়ে৷ এই লোকটা তো বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের সুপারি দানার হুমকি দিতে পারে৷ শালা,যত হুজ্জুতি সাধারণ মধ্যবিত্ত, গরিবের ওপর৷ পাক্কা, শুয়োরের বাচ্চা! চোখ ঘুরিয়ে দেখছি রাতের কলকাতা৷ এবারে খোঁজার চেষ্টা করি৷ আমাদের অফিসটাকে৷ হুঁ,সোজা উত্তরদিকে…ফ্লাই ওভার বরাবর গেলে…নাহ এত বড় শহরে আমার অফিসটা৷ আমার ঘরটা কেমন হারিয়ে যাচ্ছে৷ আবার একটু অস্থির হয়ে পড়ি৷ মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে৷ কিযে হল! লোকটা এসে সব গোলমাল করে গেল? লোকটা গেছে তো? নাকি ঘাপটি মেরে আছে কোথাও৷ যদি হাতের কাছে পেতাম ব্যাটাকে পিটিয়ে তক্তা করে ছাড়তাম৷ জেলের ঘানি টানাতাম৷
            হঠাৎ কানের কাছে গম্ভীর গলায় বলল, ‘ঘানি টানাতে হলে আদালতে যেতে হবে…৷ এইটুকু বলে বিকটভাবে হাসতে থাকে৷
            হ্যাঁ যাব, সুপ্রীম কোটে যেতে হলে তাই যাব৷
            ওখানেও তো ‘জুজু’ বসে আছে৷
            মানে?
            মানে আবার কি? এটাতো আমার কথা নয় তোমাদের বঙ্কিমচন্দ্রই বলে গেছেন-‘কাঠগড়ার ভিতরে বিড়ে মাথায় সরকারি জুজু বসিয়া আছে,’তখন সেই জুজু কোর্টের কুর্শি ছাড়া চিনত না, এখন রাজশক্তির কুর্শি চিনে গেছে বুঝেছ৷ তাকে কুর্নিশ করা প্রথম  এবং প্রধান কাজ৷ আমর ঘেঁচু করবে৷…তার চেয়ে বল, তুমি কী ভাবলে? সুপারি খাবে নাকি নেবে?
            দুম করে মাথায় আগুন জ্বলে উঠল
            নিকুচি করেছে সুপারির৷ তুই কোথায় আছিস বল? তোকে আজ ছাড়বোনা আমি৷
            ‘তোমার সামনে পিছনে ভিতরে আছি’৷
           একটা লাঠি পড়ে ছিল সামনে৷ সেটা নিয়ে এলোপাথাড়ি চালাতে লাগলাম৷ আর ও ব্যাটা ছুটে বেড়াতে লাগল৷আমিও বন বন করে ঘুরছি৷
           হঠাৎ সুপর্ণা ছাদে উঠে এল৷ সে আঁতকে উঠল৷
           ‘ছাদ থেকে ঘুরে আসছি বলে এতক্ষণ কী করছ? ওদিকে চা জুড়িয়ে গেল’!
            তখন আমি লাঠিটা ফেলে দিয়ে বসে পড়েছি৷ হাঁফাচ্ছি৷ ঘাম ঝরছে৷ ও আমার পাশে বসে বলে,
            ‘কী হয়েছে তোমার?কার পিছনে দৌড়োচ্ছিলে?’
            বললাম, লোকটা আমাকে ক্রমাগত ভয় দেখাচ্ছিল৷ সে দৃশ্যমান নয়৷ ‘তারমানে কে সে’?
            হঠাৎই টেরেসের ছাদ থেকে অদৃশ্য লোকটা বলল,
           ‘অর্কবাবু আমাকে চিনতে পারলে না?’আমি জোর গলায় চিৎকার করি – ‘না-আ..আা…কে তুমি?’
            হো হো হাসি আকাশময়৷
            আমি সেই ছোটবেলার জুজু৷ এই বয়সেও সেই জুজু!আমার কোনও অস্তিত্ব নেই৷ তবুও আমি জুজু৷…আমার কাজ ভয় দেখানো৷ ভয় পেলেই গেছ৷
          শুয়োরের বাচ্চা! আমি কোনও জুজুকেই ভয় পাইনি৷ ফোট্ এখান থেকে৷
         সুর্পনা কিছু বোঝার আগে বললাম,
        ‘চলো, খবরের কাগজের কালকের ইসুর জন্য অনেক কাজ জমে আাছে’!

Continue Reading

গল্প

আমার ভালোবাসা শুদ্ধ, দেবোপম…তাই নির্বাক, মিথ্যে প্রেমহীন সঙ্গমের চেয়ে স্বপ্নের প্রেমময় সঙ্গম আমাকে স্নিগ্ধতায় ভাসিয়ে দেয়

Published

on

মীরার স্বপ্নাচ্ছন্ন প্রেম

মফিদা আকবর

শীত কাতুরে মানুষকে লেপ-কম্বল যেমন করে উষ্ণতা দিয়ে আরামে ঘুমুতে দেয় তেমনই আজকাল মীরাও স্বপ্নের চাদরখানা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে যায় নিশ্চিন্তে। আহা সারাদিনের ক্লান্তির পর ঘুম। স্বপ্নের মধ্যে মাঝে মাঝে ওর আত্মাটা বেরিয়ে পড়ে। দিনমান যেসব কাজে শাসন-বারণের জালে আটকে থাকতে হয়, লোকলজ্জার ভয়ে সেঁটে থাকতে হয়, স্বপ্নের মাঝে শাসন-বারণের কোন বালাই নেই। চিন্তার লেশমাত্র নেই। মন মন রে আমার যেখানে খুশি সেখানে চল। স্বপ্নের রথে চড়ে উড়ে উড়ে চলা। আহা কি প্রশান্তি।
      স্বপ্নরথে চড়ে মীরা রাতভর টই টই করে ঘুরে বেড়ায়। টিএসসি চত্বরে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠে। শিল্পকলা একাডেমিতে একক অথবা যৌথ চিত্র প্রদর্শনী ঘুরে ঘুরে দেখে। শিল্পীদের জল রঙের ছবি অথবা শুধুই রঙের ছোপ-ছোপ আঁকিবুঁকি। অথবা স্নিগ্ধ তমাল, তরু আঁকা-বাঁকা সরু পথ কিংবা নদী বয়ে চলে গেছে বহু দূর। রঙ-তুলি দিয়ে শিল্পীদের কারুকলা খেলা। কি ভীষণ মুগ্ধতায় আটকে থাকে চোখ। কখনও কখনও মনে হয় স্নিগ্ধ আবেশে নদী যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে। আবার কখনও মনে হয় কাঁচের মত স্বচ্ছ টলটলায়মান জল। এরকম ভাবনাগুলো টুপ টুপ করে ঝরে পড়তে থাকে মীরার মনে। অথচ এই আঁকি-বুঁকির সাথে শিল্পীর মনের অজান্তে কত বিশাল খেয়াল, কত কথা, অথবা সুখ-দুঃখের রঙ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে।
       মীরা তন্ময় হয়ে এসব বিশ্লেষণে মেতে থাকে কিছু ক্ষণ। এক সময় মনে হয় দূর ছাই! আমি ভাবছি কি! আর শিল্পী কি ভেবে এসব চিত্র এঁকেছে তাই বা কে জানে? শিল্পীর মত তৃতীয় নয়ন আমার নেই! এ কর্ম আমার নয়। সুতরাং দে ছুট।
    মীরা এবার একা একা বইমেলার আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়। গ্রন্থবিতানের বইগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে এবং যা যা মন চায়, গীতবিতান থেকে শুরু করে আরও কত কি! সবকিছুই সে করে নিজের মত করে। নিজের খেয়ালে হাওয়ার পিঠে চড়ে মীরা রাজ্যের বই কিনে নিয়ে ঘরে ফিরে ঢুকে যায় রিডিং রুমে। আহা কি শান্তি। পরম শান্তি!
      বই কিনে নিয়ে আসার পর তার তর সয় না। জানতে ইচ্ছে করে কোন বইয়ে কি আছে? পৃষ্ঠার পর নান্দনিক পৃষ্ঠাগুলো গেঁথে নেয় নিজের মগজে। যেদিন সে বই পড়ে না সেদিন তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। বই পড়া মানেই মীরার মনের দুয়ার খুলে
যায়। কি এক অনন্য ভাল লাগা ছড়িয়ে পড়ে  শরীরময়। মীরা এবার শুতে যায় নবীনের সাথে। নবীন যখন মাথা ব্যথায় উহু আহা করে, মীরা তখন ওর আধা কাঁচা-পাকা চুলের গোড়ায় আঙ্গুল ডুবিয়ে রগড়ে দেয়। ওর কপালে আলতো করে চুমু খেলে নবীন ওর উপস্থিতি টের পায়। ঘুমের ঘোরে ওকে জাপটে ধরে। সুযোগ হাতছাড়া মীরাও করে না। পরম নিশ্চিন্তে নবীনের বুকে লেপটে থাকে। ওর শরীরের উষ্ণতায় জেগে যায় নবীন। ঘরময় আধো আলো, আধো ছায়া খেলা করে। এ সময় আত্মার রমণে নিজেকে পরিতৃপ্ত করে মীরা। প্রতিদিন মীরার আত্মা একবার করে স্বপ্নাচ্ছন্ন ও প্রেতাত্মা হয়। কিছুক্ষণের জন্য হলেও চলে যায় অন্য জগতে। অন্য মোহে। এসবই স্বেচ্ছাকৃত স্বপ্ন অথবা দুঃখ মীরার। নবীনকে পাওয়ার আর কোন সুযোগই নেই বলে মীরা স্বপ্নের মাঝে এভাবেই প্রতিনিয়ত নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করে। কারণ, মীরা জানে, মানুষের মন তো আর লোহার কল নয় যে, তাকে বেঁধে রাখা যায়? বাহ্যিক দিক থেকে মীরার দেহ সামাজিক, পারিপার্শ্বিকতাকে ভেদ করে একচুলও পাপ-পুণ্যের বাইরে যায় না। অথচ স্বপ্নাচ্ছন্ন মীরার অন্তর আত্মা কি নিষ্কলুষ এবং কত স্বাধীন। স্বপ্নাচ্ছন্ন মীরা মনে মনে বলে জীবনের যে কোন দিন অথবা যে কোন ভাবেই হোক আমি তোমাকে আমার স্বপ্নের মত করে আর আমার প্রেতাত্মার মত করে পেতে চাই। তোমাকে পেতে একবুক কষ্টকে কেউটের মত গলাধঃকরণ করে মরে যেতে চাই। ঈশ্বরহীন হতে চাই। পাপাগ্নির লেলিহানে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হতে চাই। তাই আমার মূর্ত এবং বিমূর্ততায় কষ্টগুলো মজে মজে, কষে কষে আমার শরীরের কোষে কোষে মাখো মাখো হয়ে লেপটে আছে। যেমন করে নাশতার টেবিলে পাউরুটিতে মাখন মাখিয়ে দেয়।
      আমি জানি, আমার ভালোবাসা কঠিনতম শুদ্ধ, আত্মপীড়িত, অনুপম, দেবোপম পুণ্য শুচি-শুভ্রতায় স্নিগ্ধ। তাই নির্বাক, স্পন্দনহীন অস্পষ্ট নিশ্চিত অসাড়তার চেয়ে, মিথ্যে প্রেমহীন সঙ্গমের চেয়ে স্বপ্নের প্রেমময় সঙ্গম আমাকে প্রতিরাতে স্বপ্নময় আত্মার রমণে নিবিড় স্নিগ্ধতায় মিঠেকড়া স্বাদে ভাসিয়ে দেয়। তখন আমার জাগতিক ছাইপাশ ভাবনা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় না। আমি তখন অন্য জগতে, অন্য মোহে, দ্বিধাহীন, নিঃসংকোচ। আহা কি শান্তি। পরম শান্তি।
Continue Reading