সঙ্গীত
শান্তিদেব ও রবীন্দ্রনাথ মহান দুই অভিন্নহৃদয় ব্যক্তিত্ব

শান্তিদেব ও রবীন্দ্রনাথ গুরুদেব নতুন গান লিখে ধরিয়ে দিতেন ছাত্রের হাতে
শান্তিদেব ও রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনে দুজনকে নিয়ে অনেক গল্প আছে। একদিন সারা দুপুর ধরে গানে সুর দিয়ে ক্লান্ত গুরুদেব, ভৃত্যকে পাঠালেন তাঁর এক ছাত্রের কাছে। সেই ছাত্র তখন গানের ক্লাস নিতে ব্যস্ত। ভৃত্যকে দিয়ে গুরুদেবকে জবাব পাঠালেন, “গুরুদেবকে গিয়ে বল, ক্লাস শেষ হলেই আসছি। সামান্য দেরি হতে পারে।“
আধ ঘন্টা পরে ছাত্র হাজির হল গুরুদেবের সামনে। চোখে পড়ল, টেবিলের ওপর গানের খাতা খুলে রেখে, গুরুদেব চুপচাপ বসে আছেন। থমথমে মুখ। না কিছু বলছেন না ছাত্রের দিকে তাকাচ্ছেন। কাটল কিছুক্ষণ। তারপর ছাত্রকে পাশে রাখা মোড়ায় বসতে বলে, হাতে গানের খাতাটি ধরিয়ে দিলেন। গুরুদেবকে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না ছেলেটি।
আরও কিছুক্ষণ পরে গুরুদেব অনুযোগের সুরে বললেন, সারা দুপুর ধরে, নতুন সুর দেওয়া গানগুলি গেয়ে গেয়ে তিনি ক্লান্ত। অথচ খবর দেওয়া সত্ত্বে সে এল দেরি করে! সব শুনে, ছাত্র অন্যায় স্বীকার করে নিয়ে, গুরুদেবের থেকে এক-এক করে সব গানগুলি শিখে নিয়ে শুরু করল গাইতে। গান শুনে খুশিতে গুরুদেব মন উঠল ভরে। অতঃপর ছেলেটিকে ভাল করে খাওয়ানোর জন্য নির্দেশ গেল ভৃত্যের কাছে। গুরুদেবের রাগ তখন গলে জল। খেতে খেতে প্রিয় ছাত্রের সঙ্গে গল্পও জুড়ে দিলেন গুরুদেব।
সাগরময় ঘোষের বড় ভাই ছিলেন শান্তিদেব ছোট বেলার নাম ছিল শান্তিময়
দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রমা করের মৃত্যুর পরে, নতুন গান হাতে লিখে গুরুদেব তাঁর যে প্রিয় ছাত্রের হাতে ধরিয়ে দিতেন, ইনিই হলেন সেদিনের সেই ছাত্র, শান্তিদেব ঘোষ। মেঘনা নদীর পূর্ব পাড়ে বাজাপ্তি গ্রামে, ছয় ভাইবোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শান্তিদেবের নাম ছিল শান্তিময়। পরের ভাই ছিলেন সাহিত্যিক সাগরময় ঘোষ, সম্পাদক রূপে দেশ পত্রিকার সঙ্গে যার সম্পর্ক ছিল আমৃত্যু। মাত্র ছ’ মাস বয়সে, বাবা কালীমোহন এবং মা মনোরমাদেবীর সঙ্গে ছোট্ট শান্তিময় প্রথম শান্তিনিকেতনে আসেন। স্বদেশকর্মী কালীমোহন ছিলেন শ্রীনিকেতনের রূপকার।
গুরুদেব তখন ‘দেহলি’-র দোতলায় থাকেন। একদিন কালীমোহনকে সপরিবারে দেখা করতে বললেন। পরদিন মায়ের কোলে, ছোট্ট শান্তিময়কে দেখে বললেন, “এই কেষ্টঠাকুরকে কোথায় পেলে!” শান্তিনিকেতনে এক বছর কাটিয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন কালীমোহন। মাঝের এক বছরে গুরুদেবের উৎসাহে, শিশুদের শিক্ষাপ্রণালী শিখতে কালীমোহন ইংলণ্ড গিয়েছিলেন। উনিশশো তেরো সালে, গুরুদেব তাকে শান্তিনিকেতনে ফিরে আসতে বলেন এবং শিশু বিভাগের যাবতীয় দায়িত্ব তুলে দেন তার হাতে। শান্তিময়, সাগরময় ও স্ত্রী মনোরমাদেবীকে নিয়ে কালীমোহন, ‘দেহলি’ বাড়ির সংলগ্ন ‘নতুন বাড়ি’-তে থাকতে শুরু করেন। তারপর গুরুদেবের ‘আশ্রম বিদ্যালয়’-এ শান্তিময়ের লেখাপড়া শুরু হয়।
উনিশশো চুরাশি সালে পদ্মভূষণে সম্মানিত শান্তিদেব সারা জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। রাশিয়ার পদক, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম, বর্ধমান ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট, রাজ্য সরকারের আলাউদ্দীন পুরস্কার, টেগোর রিসার্চ সোসাইটির ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ সম্মান, ললিতকলা অ্যাকাডেমির ফেলো, প্রবন্ধ সাহিত্যে আনন্দ পুরস্কার ছাড়া আরও অনেক পুরস্কারে ভূষিত শান্তিদেবের জীবনে সব থেকে বড় প্রাপ্তি ছিল কবিগুরুর অপার স্নেহ।
বিনোদন
মোনালি বলেছিলেন তিনি বিবাহিত কিন্তু সত্যি কি তাই

জন্ম ০৩ নভেম্বর ১৯৮৫
কলকাতা পশ্চিমবঙ্গ ভারত
পিতা শক্তি ঠাকুর
মাতা মিনতি ঠাকুর
দিদি মেহুলি ঠাকুর
জীবন সঙ্গী মাইখ রিখটার (অসমর্থিত)
সাল ২০২০। একটি জনপ্রিয় সর্ব ভারতীয় সংবাদপত্রের পাতা। সে পাতায় ছাপা হয়েছিল মোনালির একটি সাক্ষাৎকার। ২০২০ সালে প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারে মোনালি স্বীকার করেছিলেন যে তিনি বিবাহিত। তার তিন বছর আগে অর্থাৎ ২০১৭ সালে তিনি নাকি বিয়ে করেছেন। পাত্র এক সুইডিশ রেস্তোরাঁ মালিক। নাম মাইক রিখটার।
২০১৭ থেকে ২০২০। তিন বছর মোনালি তাঁর বিয়ে গোপন করেছিলেন। না কোন সংবাদ মাধ্যম। না কোন সমাজ মাধ্যম। কোথাও প্রকাশিত হয়নি মোনালির বিয়ের খবর। বিয়ের আংটি কখনও ভুলবশত ইনস্টাগ্রামে দেওয়া ছবিতে দেখা যেত। তার থেকে অনেকে মোনালির বিয়ের খবর জানতে উৎসুক থাকতেন। কিন্তু মাইক এবং মোনালি দুজনেই অত্যন্ত সফল ভাবে তাঁদের বিয়ের খবর গোপন রেখেছিলেন।
আরও পড়ুন: টিভি থেকে সিনেমা এবং রাজনীতি চিরঞ্জিত সবেতে সফল
এবার আসা যাক আর একটি জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপত্রের প্রসঙ্গে। তারিখ ১ আগস্ট ২০১৭। সেখানেও ছাপা হয়েছিল মোনালির একটি সাক্ষাৎকার। শুরুতে বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। কিন্তু মোনালি বিয়ের খবর অস্বীকার করেছেন। বলেছিলেন, ‘বিয়ে নিয়ে এত বাড়াবাড়ির কি আছে? বিয়ে হলে জানাবেন।’ এমন কি বয়ফ্রেণ্ডের নাম পর্যন্ত বলতে চাননি। কেন এত গোপনীয়তা, সেটা মোনানিই বলতে পারবেন।
মোনালি শক্তি ঠাকুরের ছোট মেয়ে। জন সমক্ষে প্রথম আবির্ভাব গায়িকা রূপে। অভিনয় তার পরে। বাংলা টেলিভিশন ধারাবাহিক ‘আলোকিত এক ইন্দু’তে প্রথম অভিনয়। মুখ্য চরিত্র ইন্দুবালার ভূমিকায়। এরপর অভিনয় করেছেন আরও দু-একটি টেলিভিশন ধারাবাহিকে। এক দিন রাজা সেন প্রস্তাব দিলেন তাঁর ছবিতে অভিনয়ের জন্য। ছবির নাম ‘কৃষ্ণকান্তের উইল।’ মোনালিকে, রাজা সেন ভ্রমরের চরিত্রে ভেবেছিলেন।
সঙ্গীত
লতাজির প্রথম পুজোর বাংলা গানের জন্ম রেস্তোরাঁয়

জন্ম: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯২৯
ইন্দোর, (বর্তমান মধ্যপ্রদেশ), ভারত
মৃত্যু: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২
মুম্বই, মহারাষ্ট্র, ভারত
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ঠিক করলেন মহাদেবি ভার্মার লেখা ছোট গল্প ‘চিনি ফেরিওয়ালা’ নিয়ে ছবি করবেন। ‘হেমন্ত বেলা প্রোডাকশন’ ব্যানারে ছবির নাম ঠিক হল ‘নীল আকাশের নীচে’। নায়ক উত্তমকুমার এবং পরিচালক ভূপেন হাজারিকা। পরে অবশ্য পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন মৃণাল সেন এবং উত্তমকুমারের বদলে নায়ক হয়েছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। মহরতে ক্ল্যাপস্টিক দিতে লতা মঙ্গেশকর কলকাতায় এলেন। লতাজিকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে অনেকের মধ্যে হাজির হয়েছিলেন এইচ এম ভি-র পি কে সেন এবং গীতিকার পবিত্র মিত্র। তখন এইচ এম ভি-র সর্বময় কর্তা ছিলেন এই পি কে সেন আর গীতিকার পবিত্র মিত্র কোম্পানিতে বাংলা গানের সব কিছু দেখাশোনা করতেন। সেই সময় এইচ এম ভি-র তরফে বাংলা গান নিয়ে যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব থাকত এই দুজনের ওপর।
লতা মঙ্গেশকর জীবনের প্রথম পুজোর বাংলা গানের জন্য পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বেছেছিলেন
দমদম এয়ারপোর্টে সকলের অগোচরে গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডেকে লতা মঙ্গেশকর বললেন, ‘আমার জীবনের প্রথম পুজোর বাংলা গান রেকর্ড করব।’ সঙ্গীত সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে দেখা করতে বহু গুণীজন উপস্থিত হয়েছিলেন। লতাজি প্রত্যেককেই বলছিলেন, ‘কাল মহরত, পরশু ফিরে যাব।’ টানটান কর্ম ব্যস্ততা অথচ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছেন, গান রেকর্ডিং করবেন। কিন্তু কি করে সেটা সম্ভব? রেকর্ডিঙের সময় কোথায়? পরদিন মহরত অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে পুলকবাবুকে ডাকলেন। বললেন, ‘সবাই জানে আমি হোটেলে আছি। আমি কিন্তু আছি ভূপেনদার টালিগঞ্জের গল্ফ ক্লাবের ফ্ল্যাটে। আপনি কাল সকালে চলে আসুন।’ এতক্ষণে পুলকবাবুর দুশ্চিন্তা কাটল। আগের দিন লতাজির প্রস্তাব শুনে বাঙালি গীতিকার বাবু তো প্রায় ভেবে বসেছিলেন যে সেটা নেহাত কথার কথা। বিখ্যাতরা তো ওরকম কথা বলেই থাকেন।
আরও পড়ুনঃ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় কেন গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন
টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে পুলকবাবুকে দেখে লতা মঙ্গেশকর হাসতে হাসতে বলে ফেললেন, ‘জানেন তো এইচ এম ভি-র পি কে সেন কি বলেছিল?’ পুলকবাবু কিচ্ছু বুঝতে পারছেন না। তখন লতাজি খোলসা করে বললেন, ‘উনি তো রেকর্ডিঙে পবিত্রবাবুর কথা বলছিলেন। আমি আর ভুপেনদা দুজনেই বলেছি আপনার নাম।’ পুলকবাবু বিষয়টা বুঝলেন কিন্তু তাঁর খটকা তখন অন্য জায়গায়। লতাজিকে জানতে চাইলেন, ‘কিন্তু রেকর্ড করবেন কখন? আপনি তো আজই ফিরে যাবেন।’ লতাজি তখন আবার হাসতে হাসতে বললেন, ‘না, না আমি যাচ্ছি না। বুঝতেই পারছেন আমি থাকছি জানতে পারলে কলকাতার সব মিউজিক ডাইরেক্টর আর গীতিকার আমাকে গানের জন্য ধরবেন। কাকে ফেরাব বলুন! আপনার চিন্তা নেই। আমি রেকর্ডিং সেরে ফিরব।’ পুলকবাবু নিশ্চিন্ত হলেন।
লতাজির প্রথম পুজোর বাংলা গান ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’
এবার ভূপেন হাজারিকার কারণে পুলকবাবু পড়লেন বিপাকে। ভূপেনবাবু বললেন, ‘আমার কিন্তু সময় হবে না। তাছাড়া গানও তো তৈরি নেই।’ পুলকবাবু বললেন, ‘একটা গান তো আছে – মনে রেখো ওগো আধো চাঁদ’। কিছুক্ষণ থেমে ভূপেনবাবু বললেন, ‘আপনার লেখা ওই গানে সুর করেছিলাম, কিন্তু আমার তো একটুও মনে নেই। এখন যে বসব, তারই বা উপায় কোথায়? হারমোনিয়াম বিগড়েছে। সারাতে দিয়েছি, এখনও দিয়ে যায়নি।’ অগত্যা ভূপেনবাবুকে নিয়ে পুলকবাবু পৌঁছলেন তাঁর দিদির ভবানীপুরের বাড়িতে। ওখানে ‘মরশুমী ক্লাব’ নামে একটা ক্লাব ছিল। ভূপেনবাবু সে ক্লাবের সদস্য ছিলেন। ক্লাবে উত্তমকুমার, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী প্রমুখ সবাই আসতেন।
ভূপেনবাবুকে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য ছিল ক্লাবের হারমোনিয়ামে নতুন করে ‘মনে রেখো ওগো আধো চাঁদ’ গানটাতে সুর করানো। ভূপেনবাবু কিছুক্ষণ সুর নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘অসম্ভব। আর বসতে পারব না। আমার জরুরী অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আমাকে বেরোতে হবে।’ পুলকবাবু কি আর করবেন? ভূপেনবাবুর সাথে তিনিও বেরিয়ে পড়লেন। দুজনে পৌঁছলেন চৌরঙ্গিতে। পুলকবাবু কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে হাজির হলেন চাংহুয়া রেস্তোরাঁতে। শুনেছিলেন ভূপেনবাবু ওখানে আসতে পারেন। কপাল ভাল। ভূপেনবাবুকে পেয়েও গেলেন।
আসলে পুলকবাবুর ওখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ভূপেন হাজারিকার একটা অসমিয়া গানের সুরের ওপরে একটা বাংলা গান লেখা। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল নতুন গান তিনি তখনই লিখতে পারবেন এবং লতাজি গাইলে সে গান ভালই হবে। ভূপেনবাবু রাজি হলেন। এবার সমস্যা হল কাগজের। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পকেটে কলম আছে, দরকার শুধু একটা কাগজ, যার ওপর তিনি গান লিখবেন। শেষে রেস্তোরাঁর খাওয়ার বিলের ওপর লেখা হল গান – রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে। ভূপেন হাজারিকার সুরে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় লতা মঙ্গেশকর গাইলেন তাঁর জীবনের প্রথম পুজোর বাংলা গান।


