বিশিষ্ট
বিষ্ণু দে বাংলা কবিতায় স্বকীয়তা স্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন

তিনি জানতেন, রবীন্দ্রপ্রভাবকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা কখনই সম্ভব নয়। তবুও বিষ্ণু দে বাংলা কবিতায় স্বকীয়তা স্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামের মত, রবীন্দ্রনাথকে প্রভূত শ্রদ্ধা করতেন। আবার পাশাপাশি নিজস্ব ধারা তৈরি করতে নিজের কবিতায় রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্য ও মার্কসীয় চেতনার আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। কবিগুরুকে ভাল যে বাসতেন, তাঁর প্রমাণ নিজের কবিতায় বারবার রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতির ব্যবহার। তাঁর গান থেকে নিয়েছিলেন নিজের কাব্যগ্রন্থের নাম, ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার (উনিশশো পঞ্চাশ)’।
বিষ্ণু দে বাংলা কবিতায় স্বকীয়তায় স্থাপন করতে পেরেছিলেন তাও প্রবল রবীন্দ্রপ্রভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে
সেটা ছিল উনিশশো নয় সাল। শান্তিনিকেতনে বালিকা বিদ্যালয়ের সূচনা করে, কবিগুরু বেরিয়ে পড়েছিলেন শিলাইদহের উদ্দেশ্যে। শান্তিনিকেতনে নানা সমস্যা চলছিল। তার জন্য সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকতেন। শিলাইদহে বসে, সেসব সামলে শেষ করেছিলেন ‘গোরা’। কালের এই সন্ধিক্ষণে, জুলাইয়ের আঠারো তারিখে পটলডাঙার বিখ্যাত শ্যামাচরণ দে বিশ্বাসের পরিবারে জন্ম নিলেন এক কবি, পরবর্তীকালে রবীন্দ্রপ্রভাবিত বাংলা কবিতার ধারাকে যিনি প্রায় একার হাতে বদলে দিয়েছিলেন। তরুণ কবির লেখায় কবিগুরু স্বয়ং খুঁজে পেয়েছিলেন নতুন সম্ভাবনা।
আরও পড়ুনঃ রবীন্দ্রনাথের কবিতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনর্গল বলতে পারতেন
‘কল্লোল পত্রিকা’ (উনিশশো তেইশ) প্রকাশ দিয়ে যে সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল কবি বিষ্ণু দে ছিলেন তার অন্যতম দিশারী। উনিশশো তিরিশ সালে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ হওয়ার পরে যোগ দিয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ পত্রিকায়। সম্পাদক হিসাবে এখানে উনিশশো সাতচল্লিশ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন। অনুবাদ সাহিত্যেও তাঁর কাজ আছে। তাঁর অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে আছেএলিয়ট, পলঅ্যালুয়ার ওমাও–সে-তুঙের কবিতা। উনিশশো আটচল্লিশে চঞ্চল চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন ‘সাহিত্য পত্র’। এই চঞ্চলবাবু ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ খ্যাত ‘গুপী’ তপেন চট্টোপাধ্যায়ের কাকা।
জনপ্রিয় কবি কখনই ছিলেন না বরং স্বল্পপঠিতই ছিলেন তবুও বিষ্ণু দে ছিলেন স্বকীয়তায় ধন্য পেয়েছিলেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার
তাঁর জীবনের এক অপরিহার্য অঙ্গ ছিলেন শিল্পী যামিনী রায়। তাঁকে নিয়ে কবি জীবনের বহু সময় কাটিয়েছেন। লিখেছেন তাঁকে নিয়ে। যামিনীর জন্মদিন উপলক্ষে বিষ্ণু দে লিখেছিলেন বিখ্যাত কবিতা ‘চড়ক ইস্টার ঈদের রোজা’। অঙ্কন শিল্প নিয়ে লিখেছিলেন বই, ‘আর্ট অফ যামিনী রয়’, ‘দ্য পেন্টিংস অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর’, ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড মডার্ন আর্ট’ প্রমুখ। দুজনের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। যামিনী রায়ের অর্থকষ্টের সময়ে বিষ্ণু দে তাঁর বহু ছবি তখনকার সচ্ছল মানুষজনের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন। যামিনী রায়কে বিষ্ণু দের পুত্রকন্যারা ‘ছবি জেঠাবাবু’ নামে ডাকতেন।
বাংলা কবিতার জগতে, বিষ্ণু দে কখনই খুব জনপ্রিয় ছিলেন না। বস্তুত সমকালীন কবিদের তুলনায় স্বল্পপঠিতই ছিলেন। তবে তাঁর কবিতা, পাঠককে বাধ্য করে জগত ও জীবন সম্বন্ধে নতুন করে ভাবতে। উনিশশো পঁয়ষট্টি সালে পেয়েছিলেন সাহিত্য আকাদেমি এবং ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কাব্যগ্রন্থের জন্য উনিশশো একাত্তর সালে পেয়েছিলেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার।
বিশিষ্ট
সুধীন্দ্রনাথ শুনছেন রবীন্দ্রনাথ শেষের কবিতা পড়ছেন

কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কখনও কম কখনও আদৌ লিখতেন না
কবিতার বইয়ের সংখ্যা ছয় আর গদ্যের বই মাত্র দুই। আজকের দিনে এই প্রচারসর্বস্ব জগতে অত্যন্ত বেমানান। এখনকার সময়ে ভাবতেই বুঝি কেমন লাগে, সত্যিই তো, এত কম লিখেছেন, এত কম, কি করে হতে পারে! চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে কবিতার জগতে এক নিবিড় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে তিনি আছেন – হয় কম লেখেন অথবা কখনও আদৌ লেখেন না।
উনিশশো চৌত্রিশ – সাঁইত্রিশ, উনিশশো বিয়াল্লিশ – চুয়াল্লিশ, উনিশশো ছেচল্লিশ – বাহান্ন আবার উনিশশো সাতান্ন – ষাট, এই সব সময় কালে তিনি একটিও কবিতা লেখেননি। সেকালের কলকাতায় কেউ কম লেখালেখি করলে, একটা বহুল প্রচলিত রসিকতা ছিল, ‘তুমি কি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত হতে চাও?’
আরও পড়ুন: শুধু কবি নয় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন একজন দক্ষ সম্পাদকও বটে
সিগনেট প্রেসের দিলীপকুমার গুপ্তকে লেখা চিঠিপত্র সাক্ষী, কবিতার বই ‘সংবর্তের’ প্রুফ দেখতে গিয়েও তিনি কবিতা সংশোধন করে এসেছিলেন। চিঠিতে লিখেছিলেন ‘পাণ্ডুলিপি আর এই প্রুফ দুটোই প্রামাণ্য… যদি সব শেষের পেজ প্রুফটা একবার পাঠান, এক দিনেই দেখে ফেরত দেব।’ এও লিখেছিলেন, ‘দুর্বোধ্য বলে আমার দুর্নাম থাকাতে সাধারণ প্রুফপাঠক আমার লেখার ভুল শোধরাতে অনেক সময় ইতস্তত করেন। অতএব যদি দরকার মনে করেন, তাহলে আমিই সারা বইয়ের সর্বশেষ প্রুফ প্রেসে গিয়েও দেখে দিতে পারি, যাতে কোথাও অর্থহানি না ঘটে।’ সারা জীবন ধরে নিজের লেখা কেটেছেন, ছেঁটেছেন, জুড়েছেন এবং পালটেছেন।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুধীন্দ্রনাথকে অধ্যাপক নিযুক্ত করতে সমস্যা হয়েছিল
কাশীতে অ্যানি বেসান্তের থিওসফিক্যাল স্কুল থেকে কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, তারপর স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ কোর্সে ভর্তি। তবে এম এ পড়া তার শেষ হয়নি। জিওফ্রে চসারের কবিতা নিয়ে ক্লাস চলছে। মাস্টারমশাই বললেন, চসারের কবিতা পাঠ করতে। সুধীন্দ্রনাথ প্রথম দিন পাঠ করলেন, দ্বিতীয় দিনও পাঠ করলেন, তৃতীয় দিনে বেঁকে বসলেন। কবিতা আবার উঁচু গলায় পড়া কেন? মাস্টারমশাই ছাত্রের নামে উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে অভিযোগ করলেন। উপাচার্যের নির্দেশে সুধীন্দ্রনাথ ক্ষমা চাইলেন বটে, তবে ক্লাসে তার আর মন টিঁকল না।
বুদ্ধদেব বসু অবশ্য তাঁর ‘কবিতা’ পত্রিকার সুধীন্দ্রনাথ স্মরণ সংখ্যায় লিখেছিলেন, মতান্তরের কারণ ছিল অন্য— শেক্সপিয়রকে নিয়ে ব্যখ্যা। পরবর্তী কালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ বিভাগে সুধীন্দ্রনাথকে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করতে গিয়ে, সুধীন্দ্রনাথের প্রথাগত ডিগ্রীর অভাবের কারণে বেশ সমস্যায় পড়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ‘আংশিক সময়ের অধ্যাপক’ হিসেবে নিযুক্তি দিয়ে কোন রকমে সেই সমস্যা সামলানো হয়। অথচ সারা কলকাতা জানত, তুলনামূলক সাহিত্যে, মালার্মে-ভালেরি-রিলকে-এলিয়টের কবিতা পড়ানোয় সুধীন্দ্রনাথের চেয়ে যোগ্য শিক্ষক সেই সময় আর কেউ ছিলেন না।
ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যেও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত রীতিমত দক্ষ ছিলেন
জীবনের প্রথম দিকে বাংলা চর্চার সুযোগ পাননি, শিখেছিলেন ইংরেজি ও সংস্কৃত। উনিশশো উনত্রিশ সালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জাপান ও আমেরিকা সফর করেন। পরে একা একা ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলেন। এই বিদেশ সফরের অভিজ্ঞতার প্রভাব পড়েছিল তাঁর কাব্যের মধ্যে। ইউরোপ থেকে ফেরার পরে শুরু হয় সুধীন্দ্রনাথের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল পর্যায়। উনিশশো তিরিশ থেকে উনিশশো চল্লিশ, এই দশ বছর সময় কাল তাঁর অধিকাংশ প্রধান রচনার সৃষ্টি কাল। এই একটি মাত্র দশকের মধ্যে শেষ করেছিলেন ‘অর্কেস্ট্রা’, ‘ক্রন্দসী’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘সংবর্ত’ প্রমুখ কাব্যগ্রন্থ ও গদ্য সংগ্রহ। তাঁর সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকার সবচেয়ে উজ্জ্বল পর্যায়, উনিশশো একত্রিশ থেকে ছত্রিশ, তাও এই সময় কালের মধ্যে।
সুধীন্দ্রনাথকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘তাঁর মতো বিরাট প্রস্তুতি নিয়ে আর কেউ বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতে অগ্রসর হননি।’ এই বিরাট প্রস্তুতির মধ্যে যেমন ছিল বিপুল পড়াশোনা, সংস্কৃত ছন্দ শাস্ত্রের অগাধ জ্ঞান, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান ভাষার সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপ, তেমনই ছিল কবিতা নিয়ে তাঁর নিরন্তর ভাবনাচিন্তা। এ ভাবনার সন্ধান রবীন্দ্রনাথও পেয়েছিলেন।
হিরণকুমার সান্যাল লিখেছেন, জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথ তরুণ লিখিয়েদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পড়ে শোনাবেন ‘শেষের কবিতা’। কবিতা পাঠ চলাকালীন হঠাৎ ঔপন্যাসিক-কবি নিবারণ চক্রবর্তীর কবিতার পাশাপাশি উঠে এল ইংরেজি কবিতার কিছু অংশ। রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ অপূর্বকুমার চন্দের কাছে জানতে চাইলেন, ‘এই ইংরেজি কবিতা কার লেখা জানো?’ প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক অপূর্ব বললেন, ‘ঠাহর করতে পারছি না।’ অদূরেই চুপচাপ বসে ছিলেন এক তরুণ, উজ্জ্বল এক কৌতুক ছড়িয়ে তাঁর চোখে মুখে। তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, তিনি এই ইংরেজি কবিতা ও তার রচয়িতা সম্পর্কে দস্তুরমতো ওয়াকিবহাল। সেদিনের সেই তরুণ ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ।
বিশিষ্ট
প্রিয়নাথ ও রবির সম্পর্ক ছিল রসিক ও স্রষ্টার মত

‘জীবনস্মৃতির’ একটি অংশে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন
“এই সন্ধ্যাসংগীত রচনার দ্বারাই আমি এমন একজন বন্ধু পাইয়াছিলাম যাঁহার উৎসাহ অনুকূল আলোকের মতো আমার কাব্যরচনার বিকাশচেষ্টায় প্রাণসঞ্চার করিয়া দিয়াছিল। তিনি শ্রীযুক্ত প্রিয়নাথ সেন। তৎপূর্বে ভগ্নহৃদয় পড়িয়া তিনি আমার আশা ত্যাগ করিয়াছিলেন, সন্ধ্যাসংগীতে তাঁহার মন জিতিয়া লইলাম। তাঁহার সঙ্গে যাঁহাদের পরিচয় আছে তাঁহারা জানেন, সাহিত্যের সাত সমুদ্রের নাবিক তিনি। দেশী ও বিদেশী প্রায় সকল ভাষার সকল সাহিত্যের বড়ো রাস্তায় ও গলিতে তাঁহার সদা সর্বদা আনাগোনা। তাঁহার কাছে বসিলে ভাবরাজ্যের অনেক দূর দিগন্তের দৃশ্য একেবারে দেখিতে পাওয়া যায়। সেটা আমার পক্ষে ভারি কাজে লাগিয়াছিল।
সাহিত্য সম্বন্ধে পুরা সাহসের সঙ্গে তিনি আলোচনা করিতে পারিতেন— তাঁহার ভালো লাগা মন্দ লাগা কেবলমাত্র ব্যক্তিগত রুচির কথা নহে। একদিকে বিশ্বসাহিত্যের রসভান্ডারে প্রবেশ ও অন্য দিকে নিজের শক্তির প্রতি নির্ভর ও বিশ্বাস— এই দুই বিষয়েই তাঁহার বন্ধুত্ব আমার যৌবনের আরম্ভকালেই যে কত উপকার করিয়াছে তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। তখনকার দিনে যত কবিতাই লিখিয়াছি সমস্তই তাঁহাকে শুনাইয়াছি এবং তাঁহার আনন্দের দ্বারাই আমার কবিতাগুলির অভিষেক হইয়াছে। এই সুযোগটি যদি না পাইতাম তবে সেই প্রথম বয়সের চাষ-আবাদে বর্ষা নামিত না এবং তাহার পরে কাব্যের ফসলে ফলন কতটা হইত তাহা বলা শক্ত।“
আরও পড়ুন: ‘চিনে মরণের ব্যবসায়’ শিরোনামে লিখলেন রবীন্দ্রনাথ
শ্রীযুক্ত প্রিয়নাথ সেনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল এক শ্রেষ্ঠ সাহিত্যরসিকের সঙ্গে এক শ্রেষ্ঠ সাহিত্যস্রষ্টার। ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে জানা যায় ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ প্রকাশিত হওয়ার পরে প্রিয়নাথ সেনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। এর আগে ‘ভগ্নহৃদয়’ পড়ে প্রিয়নাথ, কবি সম্পর্কে হতাশ হয়েছিলেন।
প্রিয়নাথের লেখা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন
ফরাসি সাহিত্যের ভিক্টর হুগোর একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন প্রিয়নাথ এবং সম্ভবত রবীন্দ্রনাথও বন্ধুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই সময় ‘ভারতী’ পত্রিকাতে রবীন্দ্রনাথ হুগোর কিছু লেখার অনুবাদ করেছিলেন। এমন কি ‘প্রভাতসঙ্গীত’-এর মধ্যেও হুগোর অনুবাদ স্থান পেয়েছিল যদিও পরবর্তীকালে তা বাদ দেওয়া হয়। আঠারশো বিরাশি খ্রীষ্টাব্দে পুজোর পরে রবীন্দ্রনাথ দার্জিলিং থেকে ফিরে আসলে সার্কুলার রোডের বাড়িতে সাহিত্যচর্চা হেতু ‘সমালোচনীসভা’ স্থাপিত হয়। প্রিয়নাথ সেখানে আসতেন। সম্ভবত এই সময় প্রিয়নাথ বন্ধুকে গোতিয়ের Mademoiselle De Maupin বইটি পড়তে দেন। তারপর প্রিয়নাথকে কবি পত্র দেন, ‘এবার ভারতীতে যে কবিতাটি যাবে সেইটে সঙ্গে আনবেন। মেজদাদার Mademoiselle De Maupin খুবই ভালো লাগচে – কাল এসে শুনবেন।’
ঘটনাপঞ্জী ধরলে বোঝা যায় প্রিয়নাথের সঙ্গে কবির পরিচয় গড়ে উঠেছিল আঠারশো আশি খ্রীষ্টাব্দ বা তারও আগে থেকে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন আঠারো-উনিশ, তখন থেকেই তাঁর সাথে প্রিয়নাথের পরিচয়। ইংরেজি সাহিত্য ছাড়াও ফরাসি জার্মান ও আমেরিকান সাহিত্যে প্রিয়নাথের প্রভূত দখল ছিল।
প্রিয়নাথের লেখা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “প্রিয়নাথ সেনের এই প্রবন্ধগুলিকে সেই দূরের থেকে আজ দেখছি। সেদিনকার অপেক্ষাকৃত নির্জন সাহিত্যসমাজে শুধু আমার নয়, সমস্ত দেশের কিশোরবয়স্ক মনের বিকাশস্মৃতি এই বইয়ের মধ্যে উপলবদ্ধ করছি।” প্রকৃতপক্ষে প্রিয়নাথ ছিলেন এক সমৃদ্ধ বইপোকা।
প্রিয়নাথকে নিয়ে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন
প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় ‘তিনি যে একজন বড় লেখক হন নি – তার কারণ তিনি ছিলেন একজন বড় পাঠক।’ দুর্লভ স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়ে উৎকৃষ্ট পাঠক প্রিয়নাথ পরোক্ষ ভাবে সৃষ্টির পিপাসা মিটিয়েছিলেন যা আজকের প্রেক্ষিতে অনুধাবন করা সতত কঠিন।
প্রিয়নাথ সম্পর্কে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “সংস্কৃত, বাঙ্গালা, পার্শী ফ্রেঞ্চ ও ইংরাজী ভাষায় ও সাহিত্যে তাঁহার অধিকার ছিল।” নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “When I first saw him Preonath could read French and Italian in the original and subsequently learned other European languages. Persian he learned last and I borrowed from him a splendid edition of Hafiz’s poem with an English translation.”
বিশিষ্ট
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সাধু হবেন

বিশিষ্ট সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় জীবন দর্শন বড়ই অভিনব। রামকৃষ্ণ মিশনে থাকতে থাকতে সাধু হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাবা জোর করে বাড়ি না ফিরিয়ে আনলে হয়ত সাধুই হয়ে যেতেন। বাংলা সাহিত্যের লাভ, ভাগ্যিস তিনি ফিরে এসেছিলেন। তাই তো আমরা পেলাম সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়কে। তাঁর জীবন নিয়ে খানিক আলোচনা করা যাক!
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় জীবন দর্শন অধ্যাত্মপূর্ণ দেওঘরে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠে ছিলেন
বিমল কর…গম্ভীর মানুষ…নিপাট শুভ্র পোশাক…মাথা নীচু করে লিখে চলেছেন। মুখের দিকে না তাকিয়েই বললেন, কি করেন? সাহস পেয়ে তরুণ লেখক অনর্গল, নিজের সম্বন্ধে বলতে শুরু করলেন। সব শুনে বিমলবাবু এবার মুখ তুলে তাকালেন আর বললেন, কাল আসুন। তরুণ লেখক উত্তেজনায় রাতে ঘুমোতে পারেন না। কেন? কেন? বিমল কর কেন বললেন দেখা করতে!
পরদিন তরুণ লেখক ছুটলেন বিমল করের অফিসে। সেই এক ছবি। কোন পার্থক্য নেই। তবে আজ বসতে বললেন, সাথে চা। তারপর বাড়িয়ে দিলেন এক টুকরো কাগজ। লেখা রয়েছে ‘জীবিকার সন্ধানঃ পশ্চিমবঙ্গ’। বললেন, এই বিষয় নিয়ে আপনি তো কাজ করেছেন! জীবিকার জন্য মানুষ কি করবে, সেই নিয়ে লিখতে হবে। পারবেন? তরুণ বললেন, পারব। তবে স্বনামে লিখতে পারব না। তরুণ লেখক সরকারি চাকরি করেন। অগত্যা ছদ্মনাম ব্যবহার করা ছাড়া উপায় কি! ‘সঞ্জয়’ নামে শুরু হল লেখা। সে লেখা প্রকাশিত হল এক বছর ধরে।
আরও পড়ুনঃ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কেন আনন্দাবাজার ছেড়েছিলেন?
তরুণ লেখকের এতে কি লাভ হল, সেটা পরের কথা। তবে তিনি বিমল করের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ঢুকে পড়লেন। ধর্মতলা ট্রাম গুমটির সামনে কার্জন পার্কে রোজ সন্ধ্যায় আড্ডা বসত। চাঁদের হাট বসত সে আড্ডায়। তত দিনে বিমলদা, তরুণ লেখককে ‘আপনি’ ছেড়ে ‘তুই‘ বলা শুরু করেছেন। এবার এলো সেই সন্ধিক্ষণ। দেশ পত্রিকায় নিজ নামে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখলেন, গল্পের নাম ‘শ্বেতপাথরের টেবিল‘।‘ শ্বেতপাথরের টেবিল‘ প্রকাশের পরে, অভিনন্দন জানিয়ে অনেকে বলেছিলেন, পরশুরামের পরে বাংলা সাহিত্যে হাস্যরসের ধারা ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছিল। আপনি এসে আবার সেই মজে আসা খালে জল ছাড়লেন।
বিমল কর জানতে চেয়েছিলেন, কি করেন? তার উত্তরে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় অনর্গল নিজের কথা বলতে শুরু করেছিলেন
রামকৃষ্ণ মিশনের পত্রিকা ‘উদ্বোধনের‘ সম্পাদক স্বামী শ্রদ্ধানন্দজী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দেওঘরে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠে। সেখানে থাকতে থাকতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন সাধু হবেন। বেঁকে বসলেন বাবা। তা কি করে হয়? বাকি জীবন তিনি কি নিয়ে থাকবেন? কোন কথা নয়। পত্রপাঠ ছেলেকে ফিরতে বললেন কলকাতায়। শহরে ফিরে একটি চলচ্চিত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হল ছোট গল্প ‘পরিতোষের সিনেমা‘। তারপর কিছুদিন লেখাতে ইতি পড়েছিল।
চাকরি পেলেন শিল্প দপ্তরে। শুরু হল শিল্প সাংবাদিকতা। সরকারি পত্রিকা ‘স্মল ইন্ডাস্ট্রি নিউজে‘ একটি একটি করে বিভিন্ন জেলার শিল্পসম্পদ, জনসম্পদ নিয়ে লেখা, বিজ্ঞাপনের জন্য কপি রাইটিং, আর্ট ওয়ার্ক, ক্যাচ লাইন তৈরি ইত্যাদি সব সামলেছেন। ছিলেন শিল্পমন্ত্রী জয়নাল আবেদিনের ভারী পছন্দের মানুষ। তবে এত সবের পরেও শান্ত হত না মন। হবে কি করে? কাজগুলো সবই যে চাকরির তাগিদে। মনের খোরাক তাতে কোথায়? এর মধ্যে ঘটল একটি চমৎকার কাণ্ড। শিল্প দপ্তরে এক আধিকারিকের সান্নিধ্যে এসে মনে হল এক টুকরো মরূদ্যান পেয়েছেন। আধিকারিকের নাম অমলকান্তি ভট্টাচার্য।
‘যুগান্তর’ সাময়িকীতে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের একটি ফিচার প্রকাশিত হয় নাম ‘জেটযুগের ক্রন্দন’
অমলকান্তি কাজপাগল মানুষ। তার সাথে অবশ্য সমান তালে সাহিত্যরসিক এবং রবীন্দ্রভক্ত। প্রতি শনিবার তাঁর চেম্বারে সাহিত্যসভা বসত। এই সভায় মাঝে মধ্যে উপস্থিত হতেন ভবানী মুখোপাধ্যায়। বেহালার বাসিন্দা। তিনি কিছু দিন ‘অমৃত’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
এই সময় ‘যুগান্তর’ সাময়িকীতে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের একটি ফিচার প্রকাশিত হল। লেখার নাম ‘জেটযুগের ক্রন্দন’। একদিন শীতের সকালে, বাড়ির শ্বেতপাথরের টেবিলের ওপরে রবিবারের যুগান্তর পড়ে আছে আর তরুণ সঞ্জীব সংবাদপত্রটির দিকে মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছেন। সংবাদপত্রের পাতায় ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখে লেখক সেদিন আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন। আনন্দের আতিশয্যে বরানগরের কুঠিঘাট রোডের এ-মাথা থেকে ও-মাথা চরকি পাক খাচ্ছিলেন।
এরপর ‘অমৃত‘ সাপ্তাহিক পত্রিকায় পরপর দুটি গল্প প্রকাশিত হল। তৃতীয় গল্প প্রকাশের পরে ভবানী মুখোপাধ্যায় বললেন, খুব ভাল লিখেছ। এবার দেশ পত্রিকায় লিখবে। বিমল করের কাছে যাও। আমি বলে দিচ্ছি। বিমল কর তখন ‘দেশ‘ পত্রিকায় গল্প বিভাগ দেখতেন। সেই শুরু। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কলম এখনও চলছে।