শিল্প
পাড়ার সব বিয়ের পিঁড়ি আঁকতেন পরিতোষ সেন

থাকতেন ঢাকার জিন্দাবাহার লেনে পরিতোষ সেনের স্মৃতিকথার নামও জিন্দাবাহার
বাড়ি ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহরে ‘জিন্দাবাহার লেন’ নামে রাস্তায়। শৈশব, কৈশোর সেখানে কেটেছে। এসব কথা জানা যায় ‘জিন্দাবাহার’ নামে লেখা তাঁর স্মৃ্তিকথায়। শহর থেকে দূরে ‘বেলতলী’ গ্রামে তাঁদের আর একটি বাড়ি ছিল। পুজোর সময় ‘বেলতলী’ যেতেন। ‘জিন্দাবাহার’ স্মৃতিকথায় ‘আমি’ নামের রচনায় এ গ্রামের স্মৃতির কথা বলেছেন। বয়স তখন বছর বারো। ‘বেলতলী’ গিয়ে ডিঙি নৌকায় করে গ্রামের খাল-বিলে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। সেখানকার প্রকৃতির সমস্ত রূপ আর মাধুর্য তাঁর চেতনাকে অভিভূত, বিস্ময়াবিষ্ট করত। তাঁর নিজের কথায়, ‘এ-নিত্যলোক সত্যিই কী রসময়! কী মধুর! কী মুক্ত জীবন!’
সারা দুপুর নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে একসময় গলুইয়ে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়তেন। মাথার ওপরে প্রকৃতির অসামান্য রূপ। মাটিতে গাছের ওপরে জীবনের বিপুল সমারোহ। কেঁচো, শ্যামাপোকা, শুঁয়োপোকা, গুইসাপের বাচ্চা, আরো কত কি! নীচে জলের ভিতরে জলচর পোকা, মৌরলা, ট্যাংরা, পুঁটি, চিংড়ি এবং আরও সব বিচিত্র প্রাণী। সৃষ্টির এই ‘জটিল নক্সা’ তাঁকে কৈশোরে অভিভূত করত।
এবার পড়ুন কবিতা বিশিষ্ট কবিদের কলমে
পরিণত বয়সে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ভারতীয় ভাস্কর্য বিষয়ে। ইংরেজিতে লেখা সেই প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘ডাইনামিজম ইন ইন্ডিয়ান স্কাল্পচার’। সে লেখা উনিশশো চুরাশিতে ললিতকলা অ্যাকাডেমি প্রকাশিত কুমারস্বামী শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থে লেখাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। লেখাটি শুরু করেছিলেন বেলতলী গ্রামের কৈশোরের এই সব স্মৃতি দিয়ে।
পিতা প্রসন্ন কুমার সেন ছিলেন নামকরা কবিরাজ এবং ডাকসাইটে, রাশভারী মানুষ। পরিতোষ ছিলেন তাঁর সপ্তদশতম সন্তান। দুই পক্ষের স্ত্রীর কোলে প্রসন্নকুমারের মোট সন্তান সংখ্যা ছিল কুড়ি। এই কুড়িটি সন্তানের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ছাড়াও অন্যান্য আত্মীয়স্বজন সমেত এক বিরাট একান্নবর্তী পরিবারে পরিতোষের শৈশব কেটেছে। পরিবারের সঙ্গে সেই অর্থে কোন দিন একাত্মতা গড়ে ওঠেনি। বরং তাঁর শৈশবকে বরাবর এক বিচ্ছিন্নতা ভারাক্রান্ত করেছে। এই মনস্তাত্ত্বিক শূন্যতা নিয়েই তিনি বড় হয়েছিলেন।
এবার পড়ুন গল্প বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের কলমে
চিত্র শিল্পে পরিতোষ সেনের না ছিল পারিবারিক উত্তরাধিকার না ছিল চর্চার পরিমণ্ডল
তাঁর ছবির জগৎ শুরু হয়েছিল স্বদেশচেতনা থেকে। তারপর তা বিশ্ব পরিক্রমা করেছে। পাশাপাশি একটা সৌন্দর্যের বোধ গড়ে উঠেছিল শৈশব থেকে। এই সহজার বোধ থেকেই তিনি মুগ্ধ ও বিস্মিত হতে পারতেন দর্জি হাফিজ মিঞার পোশাক তৈরির শৈল্পিক নৈপুণ্যে পায়রা ওড়ানোর অসামান্য মুন্সীয়ানায়, সিনজেন্টার জিতেন গোঁসাইর অঙ্কনের দক্ষতায়, ডেন্টিস্ট আখতার মিঞার কাল্পনিক গল্প বানানোর প্রতিভায়। ঢাকা জেলায় তাঁদের গ্রামের এক বিরাট অর্জুন গাছও তাঁর কল্পনাকে নানা ভাবে উদ্দীপ্ত করত।
শিল্পের কোন পারিবারিক উত্তরাধিকার তাঁর ছিল না। বাড়িতে শিল্পচর্চার পরিমণ্ডলও ছিল না। তবে তাঁর এক কাকা ছিলেন, যিনি আঁকতে পারতেন। পাড়ার যত বিয়ে হল সেগুলির পিঁড়ি আঁকার ভার পড়ত তাঁর ওপর। খুড়িমার কথা খুব মজা করে বলেছেন পরিতোষ সেন। খুড়িমা নাকি তাঁকে একবার বলেছিলেন, ‘তুমার খুড়ায় এমন সুন্দর বিয়ার পিড়ি আঁকতেন, বিয়ার কুলা আঁকতেন যে পাড়ার লোক চাইয়া থাকত। তিনি যদি আইড বাইচা থাকতেন তাইলে তুমারে আর মাদ্রাজ আর্ট স্কুলে যাইতে হত না।’
চিত্রশিল্পি পরিতোষ সেন নিজেকে অত্যন্ত সামান্য মনে করতেন
উনিশশো একাত্তর সালে পরিতোষ সেন, ইউরোপ সফর সেরে যখন দেশে ফিরলেন তখন নকশালবাড়ি আন্দোলনে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল। ছবি আঁকা মাথায় উঠল। তারপর ধীরে ধীরে এই ক্রোধ আর হতাশাই ক্যানভাসে ফুটতে শুরু করল। বয়সের দিক থেকে তিনি যত পরিণত হয়েছেন, তত তাঁর ছবি বহুমুখী বৈচিত্র্যে উজ্জ্বলতর হয়েছে।
দেশ পত্রিকায় তেরশো নিরানব্বই বঙ্গাব্দের সাহিত্যসংখ্যায় ‘স্মৃতিচিত্র’ নামে এক রচনায় লিখেছিলেন, ‘তুলনামূলকভাবে আমি হয়তো অন্য পাঁচ জন নিকৃষ্ট শিল্পীর চাইতে ভালো আঁকি। কিন্তু আমার চাইতে অনেক গুণে ভালো আর্টিস্ট যে এই পৃথিবীতে বহু আছে এই কঠিন সত্যটি আমার চিত্তাকাশে ধ্রুবতারার মতো সদা দীপ্তমান হয়ে আছে। যে সামান্য ক্ষমতার আমি অধিকারী তাকে চাবুক মেরে কত দূর নিয়ে যাওয়া যায়, সেটাই আমার কাছে বরাবর চ্যালেঞ্জ হয়েছিল, আজও আছে। মানুষ তার গঠনে যেটুকু ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় তার বাইরে সে কোনও দিনই যেতে পারে না।….’
শিল্প
থার্ড থিয়েটার বাদল সরকার বলেছিলেন বেঁচে থাকা অধিক শ্রেয়

নবনীতা দেবসেনের মৃত্যুর পর জনপ্রিয় একটি সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাতকারে সবিতেন্দ্রনাথ রায় (মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স) ওরফে ভানুবাবু স্মৃতিচারণে বলেছেন, “বাদলবাবুকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই বয়সে আবার আপনি নতুন করে পড়াশোনা আরম্ভ করলেন…তাতে বাদলবাবু আমাকে বলেন যে, আসলে এই ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ বিষয়টা সম্পর্কে আমার খুব জানার ইচ্ছে, তাই নবনীতাদির কাছে শিখব বলেই ভর্তি হয়েছি।“ থার্ড থিয়েটার বাদল সরকার সম্বন্ধে আলোচনা এভাবেও শুরু করা যেতে পারে।
থার্ড থিয়েটার বাদল সরকার ছিলেন বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটারের একটি স্পর্ধা
“মৃত্যুর চেয়ে বেঁচে থাকা অধিক শ্রেয়” বলেছিলেন যে বাদল সরকার, তিনি ছিলেন বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটারের একটি স্পর্ধা। মঞ্চ না হলেও যে থিয়েটার সম্ভব, তা দেখিয়েছিলেন বাদল সরকার। লাতিন আমেরিকার ‘তৃতীয় চলচ্চিত্র’-এর আদলে ‘থার্ড থিয়েটার’ বা ‘তৃতীয় থিয়েটার’ নামে একটি নতুন থিয়েটার আন্দোলন প্রবর্তন করেছিলেন। থিয়েটারের ভাষাকে নিজের মত করে ভেঙে গড়ে একটা নতুন ভাষার রূপ দিয়েছিলেন। সংস্কৃতি থেকে শুরু করে রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিকতা, সব কিছুর কাছে ছিলেন দায়বদ্ধ। নিজের ভাবনার সাথে কখনও আপোষ করেননি। মূলত যাত্রা এবং দেশীয় ঐতিহ্যের নির্যাস নিয়ে তৈরি হয়েছিল তৃতীয় থিয়েটার।
আরও পড়ুনঃ ঐতিহ্যের স্টার থিয়েটার বেঁচে আছে ইতিহাস হয়ে বিক্রি হয়েছে বারবার
নাটকের মধ্যে কোন সুনির্দিষ্ট চরিত্রায়ন নেই। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ইচ্ছেমত চরিত্র নির্বাচন করতে পারেন। নাটকের মাঝখানে চরিত্র বদল করতে পারেন। এমন কি চাইলে, দর্শকরাও অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এই ছিল মোটামুটি তৃতীয় থিয়েটারের বৈশিষ্ট্য। যে কোন সময় মনে হতে পারে, নাটকের সব চরিত্র যেন শূন্য থেকে আগত। তারপর শুরু হয় তাদের পথচলা। ধীরে ধীরে চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। তারপর শুরু হয় তাদের অন্তর্লীন হয়ে যাওয়া। এই ভাবে নাটকটি সার্বিক ইতিবাচক রূপ নেয়।
বাদল সরকার মানে সত্তরের টালমাটাল সময়ে থিয়েটারকে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাতিয়ার রূপে ব্যবহার
সত্তর দশকের টালমাটাল বাংলায় নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাতিয়ার স্বরূপ সাধারণ মানুষের মধ্যে বাদল সরকারের নাটকের এই নতুর ফর্ম দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। নাটকের দল ‘শতাব্দী’ প্রতিষ্ঠা করেন উনিশশো ছিয়াত্তর সালে। ভারতীয় নাট্যজগতে স্বকীয়তার গুণে আধুনিক নাট্যকার বলে যারা বিশেষ রূপে পরিচিত, যেমন হাবিব তনভীর, বিজয় তেণ্ডুলকার, গিরিশ কারনাড, তাঁদের সাথে এক ডাকে উচ্চারিত হয় বাংলার এই ছকভাঙা নাট্যকারের নাম।
পেশায় ছিলেন টাউন প্ল্যানার। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে এঞ্জিনীয়ারিং পাশ করেছিলেন শিবপুর থেকে। সহপাঠী ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল। সাহিত্য ও নাটকের প্রতি অপরিসীম উৎসাহের কারণে বৃদ্ধ বয়সে, তুলনামূলক সাহিত্য পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। পেয়েছিলেন সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার। পেয়েছিলেন পদ্মশ্রী। ভারত সরকারের থেকে ১৯৯৭ সালে পেয়েছিলেন সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি সংস্থার সর্ব্বোচ্চ পুরস্কার “রত্ন সদস্য”।
শিল্প
ঐতিহ্যের স্টার থিয়েটার ইতিহাস হয়ে বেঁচে বিক্রি হয়েছে বারবার

শহর কলকাতার বুকে ঐতিহ্যের স্টার থিয়েটার ইতিহাস হয়ে বেঁচে আছে। তাকে নিয়ে কত গল্প, কত কাহিনা। হোরমিলার কোম্পানির গণেশদাস মু্সুদ্দির ছেলে ছিলেন গুর্মুখ রায়। যে কোন মূল্যে বিনোদিনীকে পেতে তিনি নতুন থিয়েটার খুলতে ছিলেন বদ্ধপরিকর। শেষে আটষট্টি বিডন স্ট্রিটে জমি ইজারা নিয়ে থিয়েটার খোলা হল। তবে থিয়েটারের নাম বিনোদিনীর নামে হল না। থিয়েটারের নাম রাখা হল ‘স্টার’। গিরিশ ঘোষের নাটক ‘দক্ষযজ্ঞ’ দিয়ে উদ্বোধন হল থিয়েটার। কয়েক বছর পরে, থিয়েটার ছাড়তে বাধ্য হলেন গুর্মুখ। অমৃতলাল মিত্র, হরিপ্রসাদ বসু এবং দাসুচরণ নিয়োগীকে সঙ্গে নিয়ে, অমৃতলাল বসু মাত্র এগারো হাজার টাকার বিনিময়ে স্টারের নতুন মালিক হলেন।
ঐতিহ্যের স্টার থিয়েটার ইতিহাস হয়ে বেঁচে নটী বিনোদিনীর জন্য তৈরি হয়েছিল অথচ নটীর নামে নামকরণ হয়নি কি আশ্চর্য
ওদিকে ‘বেল্লিকবাজার’ নাটকে রঙ্গিণীর ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে অভিনয় জগত থেকে চিরতরে বিদায় নিলেন বিনোদিনী।পরিস্থিতি এমন হল যে স্টার থিয়েটার এবার উঠে যাওয়ার উপক্রম। মালিক পক্ষ তিরিশ হাজার টাকায় স্টার থিয়েটার বিক্রি করলেন গোপাললাল শীলকে। স্টারের নতুন নাম হল ‘এমারেল্ড থিয়েটার’। তৈরি হল নাটকের নতুন দল। তবে এতসব করেও এমারেল্ড ওরফে স্টারকে টিকিয়ে রাখা গেল না। এমারেল্ড উঠে যাওয়ার পর অমরেন্দ্রনাথ দত্ত সেখানে চালু করলেন ক্লাসিক থিয়েটার। প্রথম দু’-একটা শো হওয়ার পরেদত্তবাবুর কপালে আবার ভাঁজ পড়ল। দর্শককে যে কোন মতেই থিয়েটারমুখী করা যাচ্ছিল না।
আরও পড়ুনঃ movies banned in India বা নিষিদ্ধ সিনেমা কাকে বলে?
দর্শক টানতে স্টার থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছিল ক্ষীরোদপ্রসাদের বিদ্যাবিনোদের আলিবাবা
এরই মধ্যে খড়দহের শিরোমণি বংশের গুরুচরন ভট্টাচার্যের ছেলে, জেনারেল অক্টারলি কলেজের রসায়নের অধ্যাপক, রিচার্ড বার্টনের অনুবাদকে ভিত্তি করে একটি নাটক লিখে ফেলেছেন। নাটকের নাম আলিবাবা। প্রচুর গানে জমজমাট সে এমন এক রঙ্গনাট্য, কলকাতার দর্শক যা আগে কোন দিন দেখেনি। নতুন নাট্যকারের নতুন নাটক প্রযোজনার ঝুঁকি নিতে অমৃতলাল রাজি হলেন না। আলিবাবার নাট্যকার দিনের বেলায় কলেজে রসায়নের জটিল তত্ত্ব পড়াচ্ছেন, অন্য সময় নাটক নিয়ে মেতে আছেন। কলেজে যিনি অধ্যাপক ক্ষীরোদপ্রসাদ ভট্টাচার্য, রঙ্গমঞ্চে তিনিই নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ।
অমৃতলাল যে আলিবাবা নাটক বাতিল করেছেন, সে কথা অমরেন্দ্রনাথের কানে পৌঁছেছিল। বাতিল নাট্যকারের সঙ্গে এবার যোগাযোগ করলেন নতুন নাট্যপ্রযোজক। সিদ্ধান্ত হল আলিবাবা মঞ্চস্থ হবে। বিভিন্ন চরিত্রের জন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীও বাছাই হয়ে গেল। ঠিক হল হুসেনের চরিত্রে অভিনয় করবেন অমরেন্দ্রনাথ নিজে, আলিবাবা ও কাশিমের চরিত্রে যথাক্রমে পূর্ণচন্দ্র ঘোষ এবং হরিভূষণ ভট্টাচার্য। মুস্তাফা ও আবদাল্লার চরিত্রে অভিনয় করবেন অজয়কুমার চক্রবর্তী ও নৃপেন্দ্রচন্দ্র বসু। অতীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য হলেন দস্যু-সর্দার, মর্জিনার চরিত্রে কুসুমকুমারী আর ফতেমা আর সাকিনার চরিত্রে যথাক্রমে রাণীসুন্দরী ও ভূষণকুমারী।
আলিবাবা নাটক থেকেই ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ নাট্যকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন
বিশে নভেম্বর আঠারশো সাতানব্বই। কলকাতা তথা বাংলার রঙ্গমঞ্চে রচিত হল এক বিপ্লব যাকে বিস্ফোরণ বললেও অত্যুক্তি হয় না। বাংলা নাটকের ইতিহাসে এক যুগান্তের অবসান ঘটিয়ে বাংলা রঙ্গালয়ের নতুন জন্ম হল। সেদিন তার সাক্ষী ছিলেন মাত্র কয়েকজন। ভিড় জমতে দেরি হয়নি। ‘আলিবাবা’ মঞ্চস্থ করে অমরেন্দ্রনাথ দত্ত সে যুগে লক্ষাধিক টাকা লাভ করেছিলেন।
সম্মান পেলেন অমরেন্দ্রনাথ আর ক্ষীরোদপ্রসাদ পেলেন নাট্যকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা। একসময় যে স্টার ক্ষীরোদপ্রসাদকে বাতিলের দলে ফেলে দিয়েছিল পরবর্তী কালে সেই স্টারেই ক্ষীরোদপ্রসাদের অনেক নাটক মঞ্চস্থ হয় যেমন জুলিয়া, দক্ষিণা, সপ্তম প্রতীক্ষা, সাবিত্রী, বঙ্গের প্রতাপাদিত্য, বৃন্দাবন বিলাস। নাট্যকাররূপে তিনি জনপ্রিয়তা পেলেও ব্যক্তিজীবনে তৈরি হয়েছিল ঘোর সঙ্কট। কলেজের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড জন মরিসন বললেন হয় নাটক ছাড় নয়তো কলেজ ছাড়। ক্ষীরোদপ্রসাদ শেষে কলেজ ছাড়াই মনস্থ করেছিলেন। বাংলা রঙ্গমঞ্চের এই অসামান্য প্রতিভাকে বাঙালি প্রায় ভুলতে বসেছিল। নাট্যকারের জন্মসার্ধশতবর্ষে, তাঁর জন্মস্থান খড়দহে এবং কলকাতায় সুদীর্ঘ কাল পরে মর্মরমূর্তি স্থাপন করে, দেরিতে হলেও কলকাতা তাঁকে মনে রাখতে উদ্যোগী হয়েছে।
শিল্প
পি সি সরকার ধর্মতলার মুখে নেতাজি বললেন, জাপান যাও

কলেজ স্ট্রীটে একদিন এক প্রকাশনা সংস্থায় আড্ডা চলছে। পি সি সরকার সেখানে হাজির হলেন। ব্যায়ামবিদ বিষ্ণুচরণ ঘোষের আত্মীয় বুদ্ধ বসু হিমালয়ের ছবি তুলে এনেছেন। সবাইকে তা দেখানোর ব্যবস্থা করেছেন। প্রকাশক মহাশয় পি সি সরকারকে সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। এরপর সেখানে এসে দাঁড়ালেন আশুতোষ কলেজের অধ্যাপক বিজনবিহারী ভট্টাচার্য।
পি সি সরকার ভারতীয় জাদুকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন
প্রকাশক মহাশয়, বিজনবাবুকে বাংলার অধ্যাপক বলে পরিচয় করিয়ে দিতে, নবাগত ব্যক্তি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘আমি শুনেছি আপনি অর্থনীতির অধ্যাপক।‘ বিজনবাবু বললেন, ‘আমি অর্থের ধারে-কাছেও হাঁটি না।‘ উত্তরে তিনি বললেন, ‘কে বললে? এই তো আপনার চাদরে টাকা।’ ডান হাতে তুলে দেখালেন এক টাকা। তারপর বাঁ হাতেও তুলে নিয়ে দেখালেন আর একটি টাকা। সবাই হতভম্ব। এভাবে মানুষের গা থেকে টাকা বেরোয় কি করে? ভুল ভাঙল কিছুক্ষণ পরে। সবাই বুঝল, এ নিশ্চয় ম্যাজিক। তবে এত অল্প সময়ে এমন ঠাসাঠাসির মধ্যে কি করে তিনি এমন চমৎকার ম্যাজিক করে দেখালেন, সেটা আড্ডার কেউ ভেবে কুলকিনারা করতে পারল না।
বিজনবাবুকে দিয়ে শুরু হয়েছিল। তারপর আড্ডায় সকলকে মন্ত্রমুগ্ধ করে জনৈক জাদুকর দেখাতে শুরু করলেন একটার পর একটা অসাধারণ ম্যাজিক। স্বচক্ষে না দেখলে সেসব বিশ্বাস করা যায় না। শুধু যাদু কেন, সেই মানুষটির অমায়িক ব্যবহারও সেদিন আড্ডার সবাইকে মুগ্ধ করেছিল।
জাদুকর প্রতুল চন্দ্র সরকার নেতাজিকে ‘সুভাষদা’ নামে ডাকতেন
প্রকাশক মহাশয় জানতে চাইলেন, ‘তা সরকার সাহেব, নতুন খবর কি? কলকাতায় কবে শো হচ্ছে? উত্তরে সরকার মশাই জানালেন, ‘সে কথা বলতেই তো ছুটে আসা। ছায়া সিনেমা হলে নতুন শো-এর ব্যবস্থা হচ্ছে।‘ আরও বললেন, ‘আমাকে বেশ কয়েকজনের একটা লিস্ট দেবেন। কমপ্লিমেন্টারি টিকিট পাঠাব। আশু আর নীহারকেও আসতে বলব। জানেন, আশু, আপনাদের আর্টিস্ট আশু বন্দ্যোপাধ্যায় আর নীহার মানে নীহাররঞ্জন গুপ্ত আর আমি, এই তিন বাঙাল অবসর পেলেই এক সাথে ঘুরতে বেরোই। পকেট তো ভাঁড়ে মা ভবানী! পথঘাট দেখেই সময় কাটে। আজ তো ভগবানের দয়ায় তিনজনই কিছু করে খাচ্ছি। আড্ডায় এবার প্রবেশ করলেন বিভূতিভূষণ। সরকার মশাই তাঁকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে উঠলেন, ‘আপনাকেও যেতে হবে আমার ম্যাজিক দেখতে।‘
উনিশশো পঁয়তাল্লিশের আঠারো আগস্ট নেতাজির কি হয়েছিল
এই মানুষটি ছিলেন জাদুকর প্রতুল চন্দ্র সরকার, পি সি সরকার নামে যিনি দর্শকদের কাছে বেশি পরিচিত ছিলেন। নেতাজিকে সরকার মশাই ‘সুভাষদা’ নামে ডাকতেন। তাঁর সঙ্গে নেতাজীর পরিচয় স্বরস্বতী প্রেসে। সেকালে স্বরস্বতী প্রেসে শহরের বহু বিশিষ্ট মানুষ মিলিত হতেন। অগণিত বাঙালি যুবকের মত প্রতুল চন্দ্র সরকারও নেতাজির ভাবমুর্তির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। নেতাজির জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপ চালাতে, যাদু প্রদর্শনীর মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করতেন। নেতাজির অনেক নির্দেশ পৌঁছে দেওয়ার কাজেও তিনি বাহকের কাজ করেছেন।

জাপান যেতে তাঁকে স্বয়ং নেতাজি উৎসাহিত করেছিলেন। ঔপনিবেশিক শাসনের প্রেক্ষিতে এক বাঙালি শিক্ষিত যুবক, সরকারি অফিসে করণিক না হয়ে যে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একটি বিষয়কে জীবিকা করতে চাইছেন, সেটা নেতাজির কাছে সরকার মশাইকে খুব প্রিয় করে তুলেছিল। সরস্বতী প্রেসে এসে সময় পেলে, তাঁর সঙ্গে নেতাজীর কথা হত। নেতাজি বলেছিলেন, ‘প্রতুল! ইংরেজরা কোন ভারতীয়কে যোগ্য সম্মান দেয় না। তার বদলে তুমি জাপান যাও। জাপানিরা প্রতিভাকে সম্মান দিতে জানে।‘
নেতাজির নির্দেশে পি সি সরকার জাপান যেতে উৎসাহিত হয়েছিলেন
জাপান সফর সহজ কাজ নয়। বিদেশে প্রদর্শনী করতে দরকার প্রচুর অর্থ এবং প্রস্তুতি। তাছাড়া স্থানীয় প্রশানের সহযোগিতাও দরকার। জাপান যাওয়ার চিন্তা ক্রমশ পি সি সরকারকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। একদিন তুমুল চিন্তামগ্ন হয়ে ভবানীপুর থেকে হেদুয়ার দিকে সরকার মশাই রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, হঠাৎ ধর্মতলার মুখে একটা কাল অস্টিন গাড়ি এসে তাঁর পথ আটকাল। গাড়ির ভিতর থেকে জলদগম্ভীর স্বরে ভেসে এলো নির্দেশ, ‘উঠে এসো।‘ গলা চিনতে ভুল হয়নি। প্রতুলকে তুলে নিয়ে গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। তারপর এলো সেই চূ়ড়ান্ত নির্দেশ, ‘রাসবিহারী ডেকেছে। তুমি নিশ্চয় যাবে! ওখানে কয়েকটা প্রদর্শনী করবে আর ওর জন্য কিছু তহবিল সংগ্রহ করে দেবে।‘ বাস্তবে সে সময় জাপানে বসে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য, রাসবিহারী বোস, অক্লান্ত পরিশ্রম করছিলেন।
অর্থের অভাবে, জাহাজে ‘ডেক’-এর টিকিট কাটতে হয়েছিল। সম্পূর্ণ সাগর যাত্রায় মাথার ওপর খোলা আকাশকে সঙ্গী করে পি সি সরকার, কোবে শহরে পৌঁছে, আবিষ্কার করলেন দরকারি কাগজ সর্বোপরি তাঁর জাদুবাক্স, সব উধাও হয়েছে। বহু সাধ্যসাধনার পর যাও বা ভিসা মিলল, তাও কিনা পর্যটনের জন্য। অদম্য প্রতুল, জাপানে বসবাসকারী কিছু ভারতীয়দের সাহায্যে অবশেষে সে দেশে জাদু দেখানোর সুযোগ পেয়েছিলেন।
পি সি সরকারকে নেতাজি পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘এই আত্মসম্মান জিইয়ে রাখ। একদিন তুমি শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসবে।’
তবে তাঁর সব থেকে বড় সমস্যার জায়গা তৈরি হয়েছিল প্রয়োজনীয় আয়োজন এবং যথেষ্ট সংখ্যক সহযোগীর অভাব। প্রায় খালি হাতে অজানা অচেনা দেশে জাদু দেখানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। এই কারণে, সরস্বতী প্রেসেও প্রতুল যাদু দেখাতে রাজি হতেন না। এমন কি তাঁর প্রিয় ‘সুভাষদা’ বললেও নয়। একবার ‘সুভাষদা’-র কথায় তাঁর খুব রাগ হয়েছিল। নেতাজির রুমাল প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে সেবার প্রতুল তাঁর জাদু দেখাতে শুরু করেছিলেন। শেষে নেতাজি পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘এই আত্মসম্মান জিইয়ে রাখ। একদিন তুমি শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসবে।‘
সেদিন জাপানে, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। সামান্য কিছুক্ষণের জাদুতে তিনি আসর মাতিয়ে দিয়েছিলেন। প্রদর্শনীর শেষে, জাপানি জাদুকরদের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক তৈরি হয় প্রতুলের। নিজেরা টাকা তুলে জাপানিরা, প্রতুলের প্রদর্শনীর আয়োজন করে। ভিসার শর্ত শিথিল করতেও তারা সাহায্য করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, বিশে জুন উনিশশো সাঁইত্রিশ তারিখটা প্রতুল চন্দ্র সরকারের জীবনে বিপ্লব এনে দিয়েছিল। সেদিন থেকে সারা বিশ্ব তাঁকে পি সি সরকার নামে চিনতে শুরু করে।

