গল্প
সাত দিনেই মোহভঙ্গ ভেবেছিল নিজেকে শেষ করবে
নিত্যরঞ্জন দেবনাথ
গাড়িতে চেপে বসল নীলা। চৌমাথা থেকে উত্তর দিকের রাস্তাটা ধরল। এলাকায় প্রভুত উন্নতি হয়েছে। কাঁচা রাস্তা সব পাকা হয়েছে। দু’ কিলোমিটার গেলেই তার জন্মভিটে। ওরে ব্বাস! গ্রামের ভেতর দিয়েও ঢালাই রাস্তা। বিশ বছরে এত উন্নতি? গাড়িটা বাড়ির দিকে বাঁক নিতেই নীলার চক্ষু স্থির। কাকে দেখছে সম্মুখে? অমৃতা না? হ্যাঁ ঠিক তাই। অমৃতার কি গ্রামেই বিয়ে হয়েছে? না হলে এখানে কেন? নীলার বেস্ট ফ্রেন্ড। অথচ বিদায় নেওয়ার সময় তার সঙ্গেও দেখা করেনি। ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয়নি। কেন যে এমন মতিভ্রম হল? রঙিন স্বপ্নে বিভোর। কাউকেই জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। অমৃতা, পলাশ এমন কি বাবা-মাকেও ফাঁকি দিয়ে বেপাত্তা হয়েছে। আজ অমৃতাকে দেখে মন লাফিয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি দাঁড় করাতে বলল। অমৃতা এই দিকেই আসছে। কোথায় যাচ্ছে কে জানে।
একেবারে মুখোমুখি, ” কিরে? কোথায় চললি? চিনতে পারছিস?”
অমৃতা দেখেই হকচকিয়ে উঠেছে। নির্বাক! অপলক চোখে দেখছে তাকে।
“কিরে? চিনতে পারিসনি? কথা বলছিস না কেন?”
অমৃতা বলল, “তোকে যে দেখতে পাব কল্পনাও করিনি। বুঝতে পারছি, সুখের সাগরে ভাসছিস। সুন্দরী আগেও ছিলি, কিন্তু এমন অপরূপা, শরীরের এত জেল্লা, তোকে তো রাজরাণীর মত লাগছে রে। বয়সটা একটুও বাড়েনি দেখছি। কোন যাদুতে ধরে রেখেছিস বল তো? তা এত দিন উধাও হয়ে গেলি কেন? আমাদের কথাও কি মনে পড়েনি?”
নীলা বলল, “এক সঙ্গে এত প্রশ্ন! কোনটার উত্তর দেব বল তো? তোদের সঙ্গে দেখা করতেই তো এলাম। তা কেমন আছিস বল?”
অমৃতা কানের কাছে ফিস ফিস করে বলল, “কিরে? নাগর পাল্টে ফেলেছিস নাকি? যার সঙ্গে পালিয়েছিলি সেতো এ নয়? কি ব্যাপার বল তো?”
নীলা বলল, “যে বেশি সুখে রাখবে তার সঙ্গেই তো থাকবো নাকি? ছাড় এসব কথা, তোর খবর বল? তোর কি কাছেই বিয়ে হয়েছে নাকি?
“নারে, আমার শ্বশুর বাড়ি যাদবপুর। কিন্তু বরের সঙ্গে দিল্লিতে থাকি। এক সপ্তাহের জন্য বাপের বাড়ি এসেছি। ছেলে-মেয়েদের এখন বড়দিনের ছুটি তাই জোর করে মামার বাড়ি নিয়ে এলাম। তাতেই না তোর সঙ্গে দেখা হল।”
“একেই বলে টেলিপ্যাথি। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড না? এতদিন পর এলাম। বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে না তা কি করে হয়? তা ছেলে-মেয়েরা কোন ক্লাসে পড়ে? অনেক বড় হয়ে গেছে নিশ্চয়ই?”
অমৃতা বলল, “ছেলেটা ইলেভেনে আর মেয়ের ক্লাস নাইন। তোর ছেলে মেয়ে কটি?”
নীলা বলল,” আমি ওই পাঠশালায় যাইনি। ইচ্ছে করেই বাচ্চা নিইনি।”
“এটা কিন্তু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। এইজন্যই শরীরটাকে রাখতে পেরেছিস। তবু বলবো মেয়েদের যৌবন কিন্তু বেশি দিনের নয়। তখন সন্তান কে আঁকড়ে ধরেই আলাদা আনন্দে বাঁচা।পরে আফসোস করবি বলে দিলাম।”
“সে দেখা যাবে। পলাশের কি খবর বল? ওর ছেলে মেয়ে কটি? ও কি চাকরি পেয়েছে?”
“পলাশ ব্যাংকের অফিসার হয়েছে।কিন্তু ওর জীবনটা তো তুই নষ্ট করে দিয়ে গেলি। বেচারা আর বিয়েই করল না। আমরা কত বোঝালাম। বন্ধুরা মিলে একটা মেয়েও দেখেছিলাম। রাজি হল না। বলে কিনা, আমি আর অন্য মেয়েকে ভালোবাসতে পারব না। ওর পরের ভাই দুটো বাধ্য হয়ে বিয়ে করে ফেলল। তুই এটা খুব অন্যায় করেছিস নীলা। এত স্বার্থপর না হলেও পারতিস। অবশ্য আর বলে কি হবে? কাল একবার আয় আমার বাড়িতে। চুটিয়ে গল্প করব। এখন একটু কাকার বাড়ি দেখা করতে যাচ্ছি। তিনদিন হয়ে গেল এখনও যাওয়া হয়নি। কাকিমা খুব রাগ করেছেন শুনলাম। যাই এখন। কাল আসিস কেমন?”
নীলা উত্তর দিল না। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। মনটা ভার হয়ে গেল। অমৃতা চলে যাচ্ছে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নীলার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। এখন ভাবছে না এলেই ভালো হতো। এই স্মৃতি বড় বেদনার। বেশ তো ছিল, কেন অতীত ঘাঁটতে এল? গাড়িতে বসেও স্বস্তি পাচ্ছে না নীলা।
সাত দিন যেতে না যেতেই মোহভঙ্গ। রাজেশ যে তাকে বিক্রি করে দিয়েছে গুণাক্ষরেও টের পায় নি। তখন মাথা খুঁড়লেও কিছু করার নেই। ফিরে আসারও পথ নেই। ভেবেছিল, রাজেশকে শেষ করে নিজেকে শেষ করে দেবে। দুর্ভাগ্য রাজেশের দেখা মেলেনি।
গাড়িটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছে। সন্ধে হয়ে গিয়েছে। চারিদিকে শঙ্খধ্বনির আওয়াজ। কত দিন শঙধ্বনি শোনেনি। এমন পবিত্র স্থানে ঢোকার অধিকার কি তার আছে? মা তুলসী তলায় প্রদীপ দিচ্ছেন। গাড়িটা একেবারে বাড়ির উঠোনে এসে থামল। নীলা বেরিয়ে এসে বলল, ‘এই এসো, আমরা এসে গেছি’। এক সুদর্শন যুবক গাড়ি থেকে নামল। বয়স বোধকরি চল্লিশের আশেপাশে। মা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন। মুখে শব্দ নেই।
নীলা পায়ে হাত দিয়ে মাকে প্রণাম করলো, “কেমন আছো মা? কথা বলছো না কেন? এই শুনছ? আমার মা”।
যুবকটিও মাকে প্রণাম করলো। তবু মায়ের মুখে কোন কথা নেই। নীলা বলল, “কি হলো মা? কিছু বলো?”
মা বললেন, “কি বলবো? এত দিনে বাড়ির কথা মনে পড়লো? আমরা তো ভেবেছিলাম তুই আর নেই। থাকলে বিশ বছর ধরে কোন খোঁজ না নিয়ে কি কেউ থাকতে পারে?”
“সে অনেক কথা। পরে বলব। বাবা কেমন আছে মা?”
“তোর বাবা খুব অসুস্থ। চাকরি থেকে রিটায়ার করেছে দু’বছর হয়ে গেল। এখনও পেনশন চালু হয়নি। আয় ঘরে আয়।”
চারিদিকে রাস্তা-ঘাটে এত উন্নতি হয়েছে। মোড়ে মোড়ে স্ট্রিট-লাইটের আলো। অথচ তাদের বাড়ির এমন জীর্ণ দশা নীলা ভাবতেই পারছে না। বাবা বরাবরই স্পষ্ট কথার মানুষ।পেনশন দেরি হচ্ছে বলে কেস করে দিয়েছেন।তাতেই বিপত্তি। সরকারের সঙ্গে কেস করে চুনোপুঁটিরা কি পার পাবে?
বাবা বললেন, “বকেছিলাম বলে কি এমন অভিমান করে থাকতে আছে মা? তোদের দেখে যে কি ভালো লাগছে কি বলবো? তোদের সুখেই তো আমাদের সুখ।”
নীলা বলল, ” আমাদের দেখে কি মনে হচ্ছে তোমাদের? ভালো আছি তো নাকি? অথচ তোমরা তো যেতেই দিচ্ছিলে না।”
মা বললেন, ” বাবা-মায়ের মন কি করে বোঝাবো তোকে? এতদিনে তোদের দেখে শান্তি পাচ্ছি। হ্যাঁরে, জামাই বাবা ওই ঘরে একা একা বসে আছে। তুই যা একবার। তোর বাবা তো বিছানা থেকে উঠতেই পারছে না। রাতে কি খায়? ভাত না রুটি? এখন চা বিস্কুট দিই?”
নীলা বলল, “আমরা এক্ষুনি বেরিয়ে যাবো মা। তোমার জামাই কলকাতার একটা কাজে এসেছে। কাজটা তাড়াতাড়ি মিটে গেলে দু’-একদিন থেকে যাব। ওকে শুধু চা দাও। আমাকে দুটো রুটি বানিয়ে দাও। কতদিন তোমার হাতের রান্না খাই না বল তো?”
বাবা বললেন, “এত রাতে কলকাতা যাবি? একি কথা বলছিস? রাতটা থেকে সকালে যাস!”
“না বাবা যেতেই হবে। আমি জোর করে নিয়ে এসেছি শুধু তোমাদেরকে দেখতে। ও বলছিল ফেরার পথে আসবে। এর আগেও দুবার এসেছি, কাজ শেষ করে ফ্লাইট ধরে চলে গেছি। আর আসা হয়নি। এবার আর রিস্ক নিইনি। যদি আগের মত সময় না পাই? ও নিয়ে ভেবো না, আমি মাস তিনেক পরেই আবার আসবো। তখন এক সপ্তাহ থাকবো।কথা দিচ্ছি। তোমার ফোন নাম্বারটা দাও বাবা। আমি আগে থেকে জানিয়ে দেব।”
নীলা ঘন্টা খানেকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল। এরই মধ্যে একটা দু’হাজার টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দিল বাবার হাতে।
বাবা অবাক! “এত টাকা! দু’লাখ টাকা দিচ্ছিস! জামাই জানে তো?”
নীলা বলল, ” ও কিছু বলবে না। ওদের বিশাল ব্যবসা। পরে আমি বলে দেব। তোমরা ভালো থেকো।”
বাবা-মাকে প্রণাম করেই বিদায় নিল। ফেরার সময় নীলা ভাবছে অন্য কথা। এর সঙ্গে তার এক মাসের কন্ট্রাক্ট। এই মাসের রোজগারের টাকাটা বাবার হাতে তুলে দিতে পেরে এক দিকে স্বস্তি হচ্ছে আবার অস্বস্তিও হচ্ছে। ঠিক করল কি?
গল্প
ভোর আর সমুদ্র মিলেমিশে একাকার…হঠাৎ বাজে সেলফোন…হাওয়া আর সাগরের ছন্দে বেমানান হয়ে ওঠে রিংটোন
পরিযায়ী
মানস সরকার
গল্প
উলঙ্গ রাজার শরীরে পোকা সে দেখেও দেখে না

চন্দন চক্রবর্তী
জুজু
বছর তিনেক হল এই আবাসনে এসেছি৷ ভীষণ সুন্দর৷ বারোতলা করে বিল্ডিং৷ সাতটা ব্লক৷ আমি ‘বি’ ব্লকে থাকি৷ করোনার প্রকোপে বাড়ি থেকে অফিস বন্ধ,ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে৷ লকডাউনেও রোগটা বেশ ছড়িয়ে পরেছে৷ নীচে বিশেষ নামা যাচ্ছেনা৷ তাই বারতলার টেরাসে এসেছিলাম৷ একটু পায়চারি করার উদ্দেশ্যে৷ উফ কী সুন্দর আামার শহর৷ অনেক আলোর ঘরবাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে৷ সবার মাথায় চেপে বসে আমি৷ সাঁঝবেলায় অন্ধকারে এক অপূর্ব মাধুর্য জড়ানো থাকে৷ সেটা জড়িয়ে শহর দেখছিলাম৷ কোনও দিন এভাবে একা শহর দেখা হয় নি৷ আজ সেই সময় সুযোগ পেলাম৷
হঠাৎ কে যেন আমার পাশে বসে পড়ল৷ আমি বুঝতে পারছি কেউ বসল৷ কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা৷
ও বলল,‘কাকে খুঁজছো?আমাকে?’
আমি একজন সাংবাদিক এবং একটি নামি বাংলা দৈনিকের সম্পাদকও বটে৷ প্রেসিডেন্সি থেকে মাস্টারস করে সাংবাদিকতা শুরু করি৷ এখন সম্পাদক৷ সুতরাং অনেক কিছু দেখা৷ কিন্তু এরকম কখনও দেখিনি কেউ পাশে এসে বসল অথচ সে দৃশ্যমান নয়৷ ভূত প্রেত এর নাম শুনেছি কিন্তু একেবারেই বিশ্বাস করিনা৷ হ্যাঁ, উপনিষদের আত্মা-তত্ত্ব মানলে আাত্মা বিদ্যমান কিন্তু দেখা যায় না৷ কাঠের মধ্যে অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো৷ তাহলে এটা কি কারও আত্মা৷ ব্যাটা ছাদে আমাকে একা পেয়ে গেঁড়ে বসেছে৷কার আত্মা? কে সে? দেখা যাক ব্যাটা কী বলতে চায়৷
‘তোমাকে খুঁজতে যাব কেন? তোমার তো অস্তিত্বই নেই৷ যাই হোক এসেই পড়েছ যখন তখন বলে ফ্যালো তুমি কে? কেনই বা এসেছ? আমার মাথাটা একটু হাল্কা করতে দাও৷ কালকের পেপারের কিছু কাজ এখনও রয়ে গেছে,যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷
ধরোনা কেন তোমাকে সেই ব্যাপারেও সাহায্য করতে পারি৷
সময় নষ্ট না করে বলো তুমি কে?
আমি দৃশ্যমান নই তবুও ছোট্টবেলা, মাঝবেলা,বুড়োবেলাতেই আমি থাকি৷ আমার নাম করে তোমাদের ভয় দেখাত৷ আর এখন এই বয়সে সত্যিই ভয় দেখাই৷
কে হতে পারে ! এতো দেখি মেমরি গেমে ফেলে দিল৷তবে বেশ মজা পেলাম৷ ছোট্টবেলায় খেতে না চাইলে বা ঘুমোতে না চাইলে মা বলতো ‘ওই হাম্বা আসছে’ অথচ তখন হাম্বা বলে কিছু চিনতাম না৷
ইতস্তত করে বলি,‘তুমি কি হাম্বা নাকি?’
ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসে৷
‘যা বাবা শেষে হাম্বা!’
‘ভাবো,ভাবো,ভাবতে থাকো৷
‘শোন আমার ভেবে কাজ নেই৷ আমার বলে চাকরির চিন্তায় মরছি৷ তুমি ফুটে যাও৷’
‘কী ভাবছ? চাকরি চলে যাবে? এই করোনা পিরিয়ডে দেশের ইকোনমি তলানিতে৷ সুতরাং কর্মী ছাঁটাই চলবে৷মাইনে কমিয়ে দেবে ইত্যাদি তাইতো!’
কিছুটা বমকে গেলাম৷ ব্যাটা বলে কি?
কিছুটা তো ঠিক৷ কিন্তু খবরের কাগজ চালানো দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে৷এভাবে চলতে পারে না৷
লোকটার গলার স্বর গাড় হল৷ কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা মনে হতে লাগল৷ অথচ আমি পোড় খাওয়া একজন সাংবাদিক কেমন ভেতর ভেতরে ঘাবড়ে গেলাম৷
আমোঘ বাণী শোনাবার মতো করে বলল,
‘চালাতে হবে, মালিক যা চাইবে তাই করতে হবে… না হলে ছোটবেলার সে এসে ঘাড়ে চাপবে৷ ছেলেপুলে নিয়ে সংসার করো, কী লাভ ওসব করে?’
তা বলে সংবাদ মাধ্যমের বা সাংবাদিকের নীতি আর্দশ? সব সমালোচনা করাই তো আমাদের মৌলিকতম কর্তব্য! আরে বাবা গনতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে কথা৷সরকারের নেতাদের ভুলত্রুটি তুলে ধরা থেকে সরে আসা যায়?
‘ধুত তেরি!এতো দেখি একেবারে আবোধা! নিজের ভালো নিজে বোঝেনা?’
শোন ‘কুর্শিকে কখনও প্রশ্ন করতে যেওনা৷ তাকে কুর্নিশ করতে শেখো৷ না হলে, কিন্তু যতই ক্ষমতাবান লেখক,কবি,সাংবাদিক হওনা কেন, এমন কেসে ফাঁসাবে বাপ্ বলার সুযোগ পাবেনা৷ সোজা ফাটকে!
‘তাই বুঝি, দেশে কি আইন কানুন নেই নাকি?
আবার ফ্যাক ফ্যাক হাসি৷ হাসির শব্দটা কানে ঢুকে সমস্ত শিরা উপশিরা ধরে মাথায় চলে যাচ্ছে হাসিতেও কেমন এক বদ গন্ধ, শরীরে পাক মারছে সেই পুতি গন্ধ!
এবারে হাসি থামিয়ে অদৃশ্য মানুষটি বলে,‘আইনকেও প্রশ্ন করোনা৷ দিনকাল খারাপ৷’
বুঝলাম,তা কী করতে হবে?
এসো, পথে এসো, ঘরে গিয়ে কাগজের হেডিংগুলো পরিবর্তন করো৷ যেগুলো ক্ষিতকারক অথচ বড় হরপে দেওয়ার কথা সেগুলো চেপে যাও৷ নতুবা, ছোট্ট করে শেষের দিকে কোথাও গুঁজে দাও৷ মোদ্দাকথা প্রো-সরকার কথাবার্ত্তা লেখ৷ দরকার হলে গলায় ঘন্টি বেঁধে তা বাজাও৷ না হলে কিন্তু…’
শালা!তুমি কি সুপারি কিলার নাকি? কত সুপারি পেয়েছিস, ব্যাটা ?বললে,‘তোমার বাড়িতে বহু সুপারি চলে যাবে৷ পায়ের ওপর পা তুলে খাবে৷ দশবার বিদেশে কাজে অকাজে যাবো৷ জীবন রঙিন হয়ে যাবে৷’
শরীর থির থির করে কাঁপতে থাকে৷লোকটি কে সামনে আসছেনা কেন? পরিচয়ও দিচ্ছেনা৷ কে পাঠিয়েছে? বেশ কিছুক্ষণ ওর শব্দ নেই৷ স্ল্যাবে বসে ছিলাম৷ উঠে আধো অন্ধকারেই খুজতে থাকি৷ ওপাশে একটা ঢাকা অংশ আছে৷ বিস্তর ময়লা জমেছে৷ ওখানেই কি গা ঢাকা দিল৷ এখন তো মনে হচ্ছে না, ব্যাটা আমার সঙ্গে আছে৷ যাকেগে্ বাঁচা গেছে৷ তবে এটুকু মনে আছে রাজা যখন কলকাতায় এসে সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন তখন হাততালির বন্যায় ভেসে যাচ্ছিলেন৷ তখন মনে মনে উচ্চৈস্বরে প্রশ্ন করেছিলাম কবির ভাষায় ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ সেটা কীভাবে রাজা শুনেছিলেন জানিনা৷ শুধু বলেছিলেন ‘প্রশ্ন করা যাবেনা’৷
সেই ভেতর প্রশ্ন আমাকে এখন তাড়া করে বেড়ায়৷ যেই কুর্শিতে বসুক৷ যত সুন্দর তা হোকনা কেন সব সময় মনে হয় রাজা উলঙ্গ৷ তার শরীরে সজস্র পোকা কিলবিল করে ঘুরছে৷ সে দেখেও দেখেনা৷ বুঝেও বোঝেনা৷ আবোধার মতো হাসে৷ সেই বোধ কলমে বেরিয়ে আসে৷ কিন্তু একা কি পারবে এই নকল বুধি গড়কে রক্ষা করতে৷
যাকগে, এসব ভেবে লাভ নেই, হয়তো ভুলভাল ভেবে চলেছিলাম৷ অথবা রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীদের হয়ে কাজ করবার মানসিকতা আমার ভিতর মনে ঢুকে যাচ্ছে৷ আর সেটাই চেতন মনে জ্বালাতন করছে৷
ছাদের প্যারাপিটের কাছে দাঁড়াই৷ উফ্, কত সুন্দর কলকাতা! অথচ এই সুন্দরের মধ্যে কত কীট! কলকাতাকে কুরে কুরে খাচ্ছে৷ তাদের কাজই ধ্বংসাত্মক৷ কিন্তু তাদেরও তো খাদ্যের প্রয়োজন! তবে যে লোকটা এসেছিল সে কি আমাকে ‘খাদ্য’ ঠাউরেছে! সর্ম্পকটা কি তবে খাদ্য এবং খাদকের৷ খাওয়ার আগে কিছু জ্ঞান দিয়ে দিল৷ যেমন যুদ্ধের আগে এক ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ হুমকি খেলা! ওই একটা হুমকিতে দেশের মানুষকে বশ করা যাবে!
লোকটি, কি আছে? নাকি ভেগেছে? কিন্তু জানা হলোনা ওর আসল পরিচয়টা কী?
দু’বার পায়চারি করলাম৷ বেশ ভালো লাগছে৷ মাথার উপর আকাশটা কত কাছে৷ রূপোলি আলোয় আলোময়৷ তারা ঝিকমিক৷ কোন গ্রহে এখনও প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায়নি৷ ভাগ্যিস, মানুষের মতো কোন প্রাণী জন্মায়নি৷ নিজেদের আধিপত্য বজায় করার জন্য ‘ভাইরাস’ যুদ্ধ ভাবা যায়৷ বাহ এখান থেকে নীচের পথ ঘাট গাছপালাও কত দূরে৷ আমি যেন মাঝে দাঁড়িয়ে৷ যেখানে খুশি চলে যেতে পারি৷ কিন্তু চিন্তার আবার লোকটা এসে পড়ে৷ এই লোকটা তো বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের সুপারি দানার হুমকি দিতে পারে৷ শালা,যত হুজ্জুতি সাধারণ মধ্যবিত্ত, গরিবের ওপর৷ পাক্কা, শুয়োরের বাচ্চা! চোখ ঘুরিয়ে দেখছি রাতের কলকাতা৷ এবারে খোঁজার চেষ্টা করি৷ আমাদের অফিসটাকে৷ হুঁ,সোজা উত্তরদিকে…ফ্লাই ওভার বরাবর গেলে…নাহ এত বড় শহরে আমার অফিসটা৷ আমার ঘরটা কেমন হারিয়ে যাচ্ছে৷ আবার একটু অস্থির হয়ে পড়ি৷ মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে৷ কিযে হল! লোকটা এসে সব গোলমাল করে গেল? লোকটা গেছে তো? নাকি ঘাপটি মেরে আছে কোথাও৷ যদি হাতের কাছে পেতাম ব্যাটাকে পিটিয়ে তক্তা করে ছাড়তাম৷ জেলের ঘানি টানাতাম৷
হঠাৎ কানের কাছে গম্ভীর গলায় বলল, ‘ঘানি টানাতে হলে আদালতে যেতে হবে…৷ এইটুকু বলে বিকটভাবে হাসতে থাকে৷
হ্যাঁ যাব, সুপ্রীম কোটে যেতে হলে তাই যাব৷
ওখানেও তো ‘জুজু’ বসে আছে৷
মানে?
মানে আবার কি? এটাতো আমার কথা নয় তোমাদের বঙ্কিমচন্দ্রই বলে গেছেন-‘কাঠগড়ার ভিতরে বিড়ে মাথায় সরকারি জুজু বসিয়া আছে,’তখন সেই জুজু কোর্টের কুর্শি ছাড়া চিনত না, এখন রাজশক্তির কুর্শি চিনে গেছে বুঝেছ৷ তাকে কুর্নিশ করা প্রথম এবং প্রধান কাজ৷ আমর ঘেঁচু করবে৷…তার চেয়ে বল, তুমি কী ভাবলে? সুপারি খাবে নাকি নেবে?
দুম করে মাথায় আগুন জ্বলে উঠল
নিকুচি করেছে সুপারির৷ তুই কোথায় আছিস বল? তোকে আজ ছাড়বোনা আমি৷
‘তোমার সামনে পিছনে ভিতরে আছি’৷
একটা লাঠি পড়ে ছিল সামনে৷ সেটা নিয়ে এলোপাথাড়ি চালাতে লাগলাম৷ আর ও ব্যাটা ছুটে বেড়াতে লাগল৷আমিও বন বন করে ঘুরছি৷
হঠাৎ সুপর্ণা ছাদে উঠে এল৷ সে আঁতকে উঠল৷
‘ছাদ থেকে ঘুরে আসছি বলে এতক্ষণ কী করছ? ওদিকে চা জুড়িয়ে গেল’!
তখন আমি লাঠিটা ফেলে দিয়ে বসে পড়েছি৷ হাঁফাচ্ছি৷ ঘাম ঝরছে৷ ও আমার পাশে বসে বলে,
‘কী হয়েছে তোমার?কার পিছনে দৌড়োচ্ছিলে?’
বললাম, লোকটা আমাকে ক্রমাগত ভয় দেখাচ্ছিল৷ সে দৃশ্যমান নয়৷ ‘তারমানে কে সে’?
হঠাৎই টেরেসের ছাদ থেকে অদৃশ্য লোকটা বলল,
‘অর্কবাবু আমাকে চিনতে পারলে না?’আমি জোর গলায় চিৎকার করি – ‘না-আ..আা…কে তুমি?’
হো হো হাসি আকাশময়৷
আমি সেই ছোটবেলার জুজু৷ এই বয়সেও সেই জুজু!আমার কোনও অস্তিত্ব নেই৷ তবুও আমি জুজু৷…আমার কাজ ভয় দেখানো৷ ভয় পেলেই গেছ৷
শুয়োরের বাচ্চা! আমি কোনও জুজুকেই ভয় পাইনি৷ ফোট্ এখান থেকে৷
সুর্পনা কিছু বোঝার আগে বললাম,
‘চলো, খবরের কাগজের কালকের ইসুর জন্য অনেক কাজ জমে আাছে’!




