Connect with us

দেশ

বিশ্বের প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য্য

Published

on

 
 
ভাষা আন্দোলন এবং কমলা ভট্টাচার্য্য
 

 

 
কমলা ভট্টাচার্যের জন্ম পূর্ববঙ্গে৷ পিতা রামরমণ ভট্টাচার্য ও মাতা সুপ্রভাসিনী দেবি৷ দেশভাগের ক্ষত বুকে নিয়ে, স্বামীহারা সুপ্রভাসিনী দেবি, সাত সন্তানকে নিয়ে শ্রীহট্ট থেকে কাছাড়ে চলে এলেন ১৯৫০ সালে। থাকতেন শিলচর পাবলিক স্কুল রোড সংলগ্ন অধুনা শহিদ কমলা ভট্টাচার্য রোডে, একটি ভাড়াবাড়িতে। অভাবের সংসার। সুপ্রভাসিনী একা লড়াই করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে শুরু করেন। ভাইবোনেদের মধ্যে কমলা ছিলেন পঞ্চম। ঘরে খাবারের অভাবও কমলার পড়াশুনোর উৎসাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারত না৷ সহপাঠিদের থেকে বই নিয়ে, কপি করে পড়াশুনো চলত৷ শতচ্ছিন্ন কাপড় পরে, কমলা স্কুলে যেতেন৷ বড়দি বেণু ভট্টাচার্যের কাছে অভিধান চাইলেও দিদি যখন তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ করেন, কমলা বলেছিলেন, ‘না না থাক এমনিই বলছিলাম৷বই ছাড়াই পড়াশুনা করে, কমলা মাধ্যমিক দিয়েছিলেন৷ বলতেন, ‘গ্রাজুয়েশন আমি নেবই৷ শহিদ হওয়ার পর মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ হলে দেখা যায় কমলা দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন।


১৯ মে, ১৯৬১। সকালবেলায় কুড়ি-বাইশ জন মেয়েদের একটা দল এসেছে বাড়িতে, কমলাকে ডাকতে। কমলা তৈরি, যাওয়ার জন্য। দাদা বাড়িতে নেই, নার্সের চাকরির প্রশিক্ষণ নিতে বড়দি শিমুলগুড়িতে। সেজদি প্রতিভা ভট্টাচার্য স্কুল শিক্ষিকা। সেজদির স্কুলে যাওয়ার জন্য কেচে ধুয়ে রাখা শাড়ি, না বলে পরে নেয় কমলা। সেজদি জানতে পারলে খুব রাগ করবে, ভাল কাপড় তো তার খুব বেশি নেই। তবে কমলার সেকথা ভাবার সময় কোথায়। পিকেটিঙে আজ যেতেই হবে। ব্যাপারটা এতক্ষণে সেজদির নজরে এসেছে, মানা করে বোনকে। কে কার কথা শোনে?  মেয়েরা আশ্বাস দেয়, কিছু হবে না মাসিমা! সেজদি! আপনি একদম ভাববেন না। স্টেশনে আমরা সবাই থাকব। সকালের ট্রেনটা আটকে দিলে, তারপর তো সারা দিন ট্রেন বন্ধ। পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে কমলা। ছোট বোন মঙ্গলাকে দেখে, কমলা বলে ওঠে
-চল, তুইও চল।
সকাল সকাল মেয়েটা খালি পেটে বেরিয়ে যাবে। ব্যাকুল মা বলে উঠলেন,
-কিছু খেয়ে গেলে হত না।
বললেন বটে, তবে মায়ের মুখ দেখে কমলা বুঝতে পারে, ঘরে খাবার কিছু নেই। খেতে কিছু না দিতে পারলেও মা একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে, মেয়েকে বললেন,
-সাথে রাখ! যদি কাঁদানে গ্যাস-ট্যাস ছোঁড়ে।
বাড়িতে মায়ের মন টেকেনাছোট ছেলে বকুল, দুই মেয়ে, নাতি বাপ্পা বড় মেয়ে বেনুর ছেলে, সবাই বাইরে, হচ্ছেটা কি? নিজে একবার না দেখলে মন মানে না সুপ্রভাসিনী নিজেই বেরিয়ে পড়লেন। চড়া রোদ, রাস্তা খালি পুলিশের গাড়ি ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। কোথায় যাবেন? মেয়েরা স্টেশনে যাবে বলেছিলওরা কি তাহলে ওখানে? স্টেশনে পাওয়া গেল ছোট ছেলেকে আর নাতিকে। পুলিশ ওদের দুজনকে ধরেছিল, পরে ছেড়ে দিয়েছে। কতজনকে ধরবে? রাখবে কোথায়? মাকে দেখে, স্টেশনের এক কোন থেকে এগিয়ে এলো দুই মেয়েএকি, মা! তুমি শুধু কাপড় জড়িয়ে এখানে চলে এসেছ, কেন? কমলা বকা দেয় মাকে। মায়ের ধুলোমাখা পা দেখে স্টেশনের কল থেকে জল এনে পা ধুইয়ে দেয়। 
-এবার বাড়ি যাও তুমি, এখানে সব শান্ত।
-তোরা যাবিনা?
-যাব, আর একটা ট্রেন আটকালেই এখানের কাজ শেষ। ওটা আটকেই বাড়ি ফিরব।
 
ছোট ছেলে আর নাতিকে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোন সুপ্রভাসিনী।
দুপুর দুটোর পরে স্টেশনের আবহাওয়া পালটে যায়। সকাল থেকে কতগুলো ট্রেন আটকানো হল। কোন গন্ডগোল নেই। সবাই মিলে বাংলাভাষা চালু করার স্লোগান দিয়ে রেল লাইনে শুধু বসে পড়াতবে এবার যেন অন্যরকম। পুলিশের সংখ্যা হঠাৎ যেন বেড়ে গেছে স্টেশনে। ওরা লাঠি আর বন্দুকের বাট দিয়ে, আন্দোলনকারিদের মারতে শুরু করেছেকিন্তু পিকেটিঙ ছেড়ে, কেউ নড়ছে নাহঠাৎ কমলার কানে এল চিৎকার, মঙ্গলার গলা, ধনদি বাঁচাও ধনদি মানে কমলা। পুলিশের লাঠির ঘায়ে লুটিয়ে পড়েছে মঙ্গলা। কমলা এগিয়ে যায় বোনকে সাহায্য করতে। লাঠির সাথে গুলিও চলছে। খেয়াল করেনি কমলা। মঙ্গলাকে ভীষণ ভাবে মারছে পুলিশ। ছুটে যায় কমলা। যাওয়া হয় না। পুলিশের বুলেট কমলার ডান চোখের পাশ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি চুরমার করে দেয়। আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ে কমলা।
ছোট শহর শিলচর। রেলস্টেশনে গুলি চলেছে। নিহত অনেক, আহত প্রচুর। হাসপাতালে মানুষের ভিড়। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে কমলার গুলি লেগেছে। জীবিত না মৃত নিশ্চিত নয় কেউ। হাসপাতাল ঘিরে রেখেছে পুলিশ, মেয়ের দেখা পেলেন না সুপ্রভাসিনী। কমলার সঙ্গীরা কান্নায় ভেঙে পড়ে তার সামনে।
-নিয়ে গিয়ে ছিলাম আপনার মেয়েকে, ফেরত আনতে পারলাম না
পাথরের মতন নীরব হয়ে বসে থাকেন তিনি। হঠাৎ মনে পড়ে মঙ্গলার কথা
-মঙ্গলা কোথায়?
মঙ্গলার কথা কেন বলছে না কেউ? মঙ্গলাও তখন হাসপাতালে। পুলিশের লাঠি ও বন্দুকের কুঁদোর আঘাতে বীভৎস রূপে আহত, সংজ্ঞাহীন। দীর্ঘ এক মাস পরে মঙ্গলার জ্ঞান ফিরেছিল।
কমলার মৃত্যুশোকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন মা সুপ্রভাসিনী। ঘুম হত না। স্বপ্নে ভেসে উঠত কমলার মুখ। তার জেদি ঘোষণা, গ্র্যাজুয়েশন আমি নেবইঘুম ভেঙে উঠে বসতেন। কাছাড়ের ডিসি এসেছিলেন আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে, নেননি।
-যারা গুলি করে মেরেছে আমার মেয়েকে, তাদের হাত থেকে নেব সাহায্য! কক্ষনো নয়।
ছুটে চলে যান বাড়ির ছাদে। টাল সামলাতে না পেরে, পড়ে যান ছাদ থেকে। গ্রাস করে মনোবিকারের। কোন উন্নতি না হওয়ায়, বড় ছেলে রামেন্দ্র ভট্টাচার্য, মাকে শিলচর থেকে গুয়াহাটি নিয়ে আসেন। কোন লাভ হয় না। মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায়, শেষে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েন শহীদ জননী। 
বিয়ের পরে, প্রতিভা ও মঙ্গলা গুয়াহাটি চলে যানপুলিশি অত্যাচারের যন্ত্রণা সঙ্গ ছাড়েনি সারা জীবন। যার শাড়ি পড়ে শহীদ হয়েছিল কমলা, সেই সেজদি প্রতিভা পরবর্তি কালে মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। বিশেষ করে কেউ কমলার কথা বললে সেই সমস্যা আরো প্রকট হত। বড়দি বেনু চক্রবর্তী চেষ্টা করেছিলেন সরকারি সাহায্য যোগাড় করতে, পারেননি। তবে বড়দির আসল দুঃখ ছিল স্বীকৃতির প্রশ্নে। বাংলাভাষার মূল স্রোতের কাণ্ডারীরা কমলার আত্মত্যাগকে, সেভাবে কোনদিন যথোচিত সন্মান দেননি। 

 

 

 

 
Continue Reading

দেশ

উৎপল কুমার বসু পুলিশ কমিশনারের কাছে ধমক খেয়েছিলেন

Published

on

উৎপল কুমার বসু

পুলিশ কমিশনারের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে উৎপল কুমার বসু মহা ফাঁপরে পড়েছিলেন। রীতিমত ধমকে উঠেছিলেন দুঁদে পুলিশ কমিশনার পি কে সেন, ‘আপনি না কলেজের অধ্যাপক? ছেলে-ছোকরাদের ফিচলেমিতে কেন নিজেকে জড়ালেন?’ রীতিমত ধমকে উঠলেন দুঁদে পুলিশ কমিশনার পি কে সেন। ‘ছেলে-ছোকরারা অসামাজিক কাজ করেছে কি? ‘ছেলে-ছোকরারা অসামাজিক কাজ করেছে কি? তবে হ্যাঁ, এদের লেখাকে যেভাবে অশ্লীল এবং অসামাজিক বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে তা আমি মানতে রাজি নই।’ ধমকানির উত্তরে এমন স্পষ্ট ভাষণ শুনতে পুলিশ কমিশনার তৈরি ছিলেন না।

উৎপল কুমার বসু পুলিশ কমিশনারের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মহা বিপত্তিতে পড়েছিলেন

তখন উনিশশো বাষট্টি সাল। সারা বাংলা জুড়ে এক অস্থির পরিস্থিতি। কথায় বলে, কবিরা সমাজ বদলাতে না পারলেও সমাজের প্রকৃত রূপকে লেখায় তুলে ধরতে পারে আর সেই থেকে নাকি সমাজ বদলায়। সমীর রায়চৌধুরি, মলয় রায়চৌধুরি, শৈলেশ্বর ঘোষ, দেবী রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়রা তাঁদের লেখা দিয়ে ঠিক এই কাজটাই করছিলেন, যাকে সমালোচক-তাত্ত্বিকরা ‘হাংরি আন্দোলন’ বলে অভিহিত করেন। এই আন্দোলনটি না ছিল কোন সংগঠিত আন্দোলন, না তাতে নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং এর প্রকাশও ছিল বিক্ষিপ্ত।

আরও পড়ুনঃ রবীন্দ্রনাথের লেখা কবিতা অনর্গল মুখস্থ বলতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

জনৈক কবি সদ্য বিএ পাশ করেছেন আশুতোষ কলেজ থেকে। হঠাৎ সুযোগ আসে জিওলজিতে অনার্স নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। সেই পড়ার সুবাদে ফিল্ড ওয়ার্ক করতে পা পড়ে চাইবাসায়। আড্ডা মারার লোভে একদিন হাজির হলেন সমীর রায়চৌধুরির বাড়ি। নিয়মিত এই আড্ডায় উপস্থিত হতে হতে ক্রমশ শক্তি-সুনীল, সন্দীপনের সঙ্গে তরুন কবিও আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন।

এমএসসি পড়ার শেষে জুটল আশুতোষ কলেজে প্রভাষকের চাকরি। ওদিকে প্রশাসন তখন যে কোন উপায়ে ভাঙতে চাইছে আন্দোলন। পুলিশের কর্তারা বেছে বেছে কবি, সাহিত্যিকদের সদর দপ্তরে ডেকে এনে হেনস্থা করছেন। তার থেকে তরুণ কবিও বাদ গেলেন না। পুলিশি জুলুমের চাপে, আদালতে তাঁকে বলতে বাধ্য করানো হয় যে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কবি ও সাহিত্যিকরা অসামাজিক কর্মে লিপ্ত এবং তাঁরা অপরাধী। 

সুনীল, শক্তি, মলয় রায়চৌধুরিদের সাথে সাথে উৎপল বসুও হাংরি আন্দোলনে জড়িয়ে গিয়েছিলেন

প্রবল চাপের মুখে তরুণ কবি জবানবন্দী দিলেন, ‘আমি অবিবাহিত, আমার বয়স ২৮।১৯৬২ সন বা তার কাছাকাছি কোন এক সময়ে হাংরি পুস্তিকা আমার চোখে পড়ে। কলেজ স্ট্রীট কফি হাউস এই আন্দেলনকারীদের আড্ডা মারার জায়গা। তাদের অনুরোধে বিভিন্ন সময়ে হাংরি পুস্তিকায় গদ্য ও কবিতা লিখেছি। কোথা থেকে ছাপানো হত আর কে তার খরচ যোগাত আমি জানি না। ১৯৬৪ সনে আমি কুসংস্কার নামে একটা লেখার পাণ্ডুলিপি দিই। তারপর আমি দু’ মাসের জন্য ডালহৌসী চলে যাই এবং কলকাতা ফিরে আমি আলোচ্য পুস্তিকাটি দেখতে পাই। পরে ডাকযোগে একটা কপি পেয়েছি। আমি মনে করি, তাদের সাহিত্য আন্দোলন নৈতিকভাবে কলুষিত হয়ে গেছে এবং আমি হাংরি আন্দেলন থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছি।’

কলকাতায় কবি ও সাহিত্যিকদের নিয়ে যখন এভাবে টানাহ্যাঁচড়া চলছে, তখন আমেরিকার বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে হাংরি আন্দেলন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি আশুতোষ কলেজ কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। কলেজ কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি তৈরি করেন এবং সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কলেজের প্রভাষকের চাকরি থেকে তরুণ কবিকে নির্বাসিত হতে হয়।

‘পিয়া মন ভাবে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন উৎপল কুমার বসু

কবি থাকেন তাঁর নিজের খেয়ালে। আছেন সব কিছুতে, আবার কোন কিছুতেই নেই। ঘুরে বেড়ান আপন মনে। লিখতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তিনি বলেন, ‘মানুষের প্রবণতাই হচ্ছে আত্মপ্রকাশ করা। সে তাই কবিতা লেখে। কবিতা লিখেই আত্মপ্রকাশের চর্চা করতে থাকে। আত্মপ্রকাশের প্রবণতা না থাকলে হয়ত মানুষ আর কবিতা লিখবে না। কিন্তু আত্মপ্রকাশের আকাঙ্খা কি কোন দিন থেমে যেতে পারে?’

হাংরি আন্দোলন বাংলা ও সাহিত্যকে কতটা সমৃদ্ধ করেছে বা আদৌ সমৃদ্ধ করতে পেরেছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা এখনও চলতে পারে। তবে হাংরি আন্দোলন ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য, হোক না তা পুলিশের চাপে পড়ে, উৎপল কুমার বসুকে, সমালোচনা ও তিরস্কার, দুয়েরই আঘাত প্রবল ভাবে সইতে হয়েছিল। দু হাজার এগারো সালে সপ্তর্ষি থেকে প্রকাশিত ‘পিয়া মন ভাবে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য দু হাজার চোদ্দ সালে কবিকে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

Continue Reading

দেশ

বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠে দেবী পক্ষের সূচনা হয়

Published

on

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও মহালয়ার ভোর

মহালয়া একটি তিথি আরমহিষাসুরমর্দিনী একটি অনুষ্ঠান। দীর্ঘ দিন ধরে বাংলা এবং বাঙালির আকাশে, এই তিথি আর অনুষ্ঠান এক সমার্থক রূপ ধরে আছে। মহালয়ার ভোরে তর্পণের সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠান শোনাও যেন বাঙালির অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্যি বলতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও মহালয়ার ভোর দিয়েই সূচনা হয় দেবীপক্ষের। তাঁর কণ্ঠের যাদুতে এখনও আপামর বাঙালি বিভোর হয়ে আছে।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও মহালয়ার ভোর দীর্ঘ সময় ধরে বাঙালির জীবনে এটাই সমার্থক হয়ে আছে

স্ত্রী একবার স্বামীকে প্রশ্ন করেছিলেন, স্তোত্রপাঠের সময়ে তোমার গলা ধরে আসে কেন? উত্তরে স্বামী বলেছিলেন, মা চণ্ডীকে তখন সামনে দেখতে পাই আমি।অনেকেই বলেন,চণ্ডীপাঠের আগে তিনি নাকি স্নান করে পট্টবস্ত্র পরে পুরোহিতের সাজে বসতেন। তবে তাঁর কন্যা বলেছেন, বাবাকে তিনি কখনও ঠাকুরকে একটি ধূপও দিতে দেখেননি।

আরও পড়ুনঃ বাংলা ও বাঙালির সব থেকে বড় আইকন মহানায়ক উত্তমকুমার

ঠাকুমা ভাল সংস্কৃত জানতেন। ঠাকুমার কাছেই সংস্কৃতের প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন বীরেন্দ্র। প্রথম বার চণ্ডীপাঠ করেছিলেন দশ বছর বয়সে, রাজেন্দ্রনাথ দে’র বাড়িতে। অঙ্কে মন ছিল না। তবে স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। ভাল আবৃত্তি করতে পারতেন। একবার এক প্রতিযোগিতায় বীরাঙ্গনা কাব্য ছিল আবৃত্তির বিষয়। চল্লিশ পাতার কবিতা মুখস্থ করতে হবে অথচ প্রতিযোগিতার তিন-চার দিন আগে পর্যন্ত ছেলের কোন তাগিদ নেইনির্দিষ্ট দিনে পৃষ্ঠা চারেক আবৃত্তি শুনে, বীরেন্দ্রকে থামিয়ে দেন, অতীব সন্তুষ্ট বিচারক। সেদিন প্রথম হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন বীরেন্দ্র।

পরশুরামের ‘চিকিৎসা সঙ্কট’ নাটক পরিচালনা দিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বেতার জীবন শুরু

চিত্রা সংসদনামে একটি ক্লাবে বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য ওরফে  বাণীকুমার, পশুপতি চট্টোপাধ্যায়, সত্য দত্ত, বিজন বসু, পঙ্কজ মল্লিক প্রমুখের সাথে বীরেন্দ্রও গানবাজনা, অভিনয় ইত্যাদি চর্চা করতেন। উনিশশো সাতাশ সালের ছাব্বিশে অগস্ট ডালহৌসির এক নম্বর গার্স্টিন প্লেসে একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপন করে বোম্বের ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি। নতুন বেতারকেন্দ্রে অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন নৃপেন মজুমদার। সহকারী রাইচাঁদ বড়াল ও রাজেন্দ্রনাথ সেন। তখন বাইরের দলও রেডিয়োয় অনুষ্ঠান করত। চিত্রা সংসদের সদস্যরা ঠিক করলেন, তাঁরাও বেতারে নাটক করবেন। পরশুরামের চিকিৎসা সঙ্কট’-এর নাট্যরূপ নিয়ে বীরেন্দ্র হাজির হলেন নৃপেনবাবুর সামনে উনিশশো আঠাশ  সালের একুশে অগস্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরিচালনায় পরিবেশিত হল সেই নাটক। 

বিএ পাশ করে চাকরি নিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে অফিসে। সময় পেলে চলে আসতেন রেডিয়ো অফিসে। শেষে রেলের চাকরি ছেড়ে বেতারের চাকরিতে যোগ দিলেন। কিছুদিন পরে আত্মপ্রকাশ হল বেতার জগৎ পত্রিকার। সাল উনিশশো ছত্রিশ জানুয়ারি ২৫, পত্রিকা প্রকাশের চার দিন আগে মারা গেলেন পঞ্চম জর্জ। সম্পাদকের ইচ্ছে পত্রিকা প্রকাশ করবেন পঞ্চম জর্জ সংখ্যা রূপেদায়িত্ব পড়ল বীরেন্দ্রর ওপর। ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি থেকে জর্জকে নিয়ে লেখা বইপত্তর জোগাড় করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন বীরেন্দ্র। নির্দিষ্ট সময়ে বেতার জগৎ প্রকাশিত হয়।

উনিশশো বত্রিশের ষষ্ঠীর ভোরে বেতারে প্রথম প্রচারিত হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ গ্রন্থনা ও শ্লোক আবৃত্তিতে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

উনিশশো বত্রিশের ষষ্ঠীর ভোরে বেতারে প্রথম প্রচারিত হয়কালজয়ী অনুষ্ঠান মহিষাসুরমর্দিনী। গানে পঙ্কজ মল্লিক আর গ্রন্থনা ও শ্লোক আবৃত্তিতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। অনুষ্ঠানের আগের রাতে আটটাটা নাগাদ শতরঞ্চি আর বালিশ নিয়ে চলে গেলেন বেতারকেন্দ্রে। কায়স্থ ঘরের ছেলে চণ্ডীপাঠ করবে, ভয় পেয়েছিলেন বেতার কর্তৃপক্ষ। তবে বাণীকুমার বলেছিলেন, ‘এটা শুধু বীরেনই করতে পারে, ও-ই করবে। অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যন্ত্রসঙ্গীতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আবেগকম্পিত কণ্ঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলে উঠলেন, ‘‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর…’’ পঙ্কজ মল্লিক হাত নেড়ে ইশারায় জানিয়ে দিলেন, ‘ঠিক আছে, চালিয়ে যাও।সেই শুরু…এখনও চলছে মহিষাসুরমর্দিনীসমগ্র বিশ্বের আর কোন বেতার কেন্দ্রে বিরামহীন এত বছর ধরে চলতে থাকা অনুষ্ঠানের এমন উদাহরণ আর একটিও নেই।

 

Continue Reading

দেশ

বিদ্যাসাগরকে সম্মান দিতে বাংলা চূড়ান্ত ব্যর্থ

Published

on

জন্ম: সেপ্টেম্বর ২৬, ১৮২০

বীরসিংহ, বাংলা, ব্রিটিশ ভারত

মৃত্যু: জুলাই ২৯, ১৮৯১

জীবন সঙ্গী: দীনময়ী দেবী

সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগর সহপাঠীর কাছে শঠতার শিকার হয়েছিলেন

সংস্কৃত কলেজের শিক্ষক জন মিয়র প্রতিযোগিতা আয়োজন করলেন পদার্থবিদ্যা বিষয়ে একশত সংস্কৃত শ্লোক লেখার। এক সহপাঠী ঈশ্বরচন্দ্রকে প্রস্তাব দিলেন, দুজনে পঞ্চাশটি করে শ্লোক লিখে পুরস্কারের অর্থ ভাগাভাগি করে নেবেন। নির্দিষ্ট দিনে সহপাঠী জানালেন, তার অংশের পঞ্চাশটি শ্লোক সে লিখতে পারেনি। তাই শুনে বিদ্যাসাগর নিজের লেখা পঞ্চাশটি শ্লোক ছিঁড়ে ফেললেন। ঈশ্বরচন্দ্র পরে জানতে পেরেছিলেন, সহপাঠী ছাত্রটি পুরো একশত শ্লোকই জমা দিয়েছে। ধূর্ত সহপাঠীর অভিপ্রায় বুঝতে ঈশ্বরের আর বাকি থাকল না। বিদ্যাসাগর পরের বছর অবশ্য পুরস্কার জিতে  নিয়েছিলেন।

সারা জীবনে বিদ্যাসাগরকে এরকম ঘটনার মুখোমুখি খুুব একটা কম হতে হয়নি। সমাজ,  পরিজন,পরিবারের থেকে আজীবন আঘাত পেয়েছেন। সাত ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই কম বয়সে মারা যায়। পিতা ঠাকুরদাস ঠিক করেছিলেন, কলকাতা ছেড়ে  কাশী বাস করবেন। বড় ছেলে ঈশ্বরের অনুরোধে মত পালটে সিদ্ধান্ত নিলেন বীরসিংহ ফিরে যাবেন। ছোট ভাই ঈশানচন্দ্র মত দিলেন, দেশে ফিরে সংসারী থাকার পরিবর্তে বাবার উচিত কাশী যাওয়া। যারপরনাই বিড়ম্বনায় পড়ে ঠাকুরদাস শেষে কাশী গেলেন। বাবার যাতে কাশীবাসে কোন অসুবিধা না হয়, তার জন্য বিদ্যাসাগর প্রায়ই কাশী যেতেন। জীবনভর এ কর্তব্য তিনি পালন করেছেন।

জীবনভর বিদ্য়াসাগর আত্মীয় পরিবার সবাইয়ের থেকে আঘাত পেয়েছেন

সংস্কৃত প্রেস ও ডিপজিটরির অধিকারের দাবিতে অগ্রজের সঙ্গে দীনবন্ধুর বিবাদ, আদালতে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। যদিও শেষে তার নিষ্পত্তি হয় সালিশির মাধ্যমে। ভাই অন্যায্য দাবি করলেও দাদা কি পিছিয়ে থাকতে পারে! গোপনে দীনবন্ধুর স্ত্রীর হাতে টাকা দিয়ে আসতেন বিদ্যাসাগর। যদিও এক সময় বিষয়টি আর গোপন ছিল না।  

আরও পড়ুন: কি আশ্চর্য! বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় হুবহু নকল

দাদাকে অপমান করতে আর এক ভাই শম্ভুচন্দ্রও কম ছিলেন না। ক্ষীরপাইয়ের কেচকাপুর স্কুলের প্রধান পণ্ডিত মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাশীগঞ্জের মনোমোহিনী দেবীর বিধবা বিবাহ থেকে, যে কোনও এক কারণে বিদ্যাসাগর নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বিধবা বিবাহের সূত্রপাত যাঁর হাতে, অগ্রজ সেই বিদ্যাসাগরকেই, শম্ভুচন্দ্র কাপুরুষবলে দোষ দিয়েছিলেন। ভাই বলেই হয়ত এমন সাহস দেখাতে পেরেছিল, নাহলে বিদ্যাসাগরের ঘোর বিরোধিদের মধ্যেও কেউ কোন দিন এমন সাহস দেখাননি।

জীবনে তিনি সব থেকে বেশি আঘাত পেয়েছিলেন পুত্র নারায়ণচন্দ্রের থেকে। পুত্রের কাজকর্মে তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে রীতিমত লিখিত আকারে ছেলের সংস্রব ও সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন। মেট্রোপলিটন কলেজের অধ্যক্ষ,সেজো মেয়ে বিনোদিনীর স্বামী সূর্যকুমার অধিকারী, হিসাবের গরমিলের দায়ে ধরা পড়েছিলেন বিদ্যাসাগরের হাতে। সদুত্তর না দিতে পারায়, বিদ্যাসাগর তাঁকে অপসাহিত করে, বৈদ্যনাথ বসুকে নতুন অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেছিলেন।  

বিদ্যাসাগর সমাজের প্রকৃত অবস্থান বুঝতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন

স্ত্রী দিনময়ী দেবীর পক্ষেও এত বড় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো কার্যত অসম্ভব ছিল। অনেক গবেষক যদিও এ নিয়ে বিদ্যাসাগরকেই দায়ী করেছেন, তবে বাস্তবে দেখা যায় স্ত্রীর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিদ্যাসাগর তাঁর ইচ্ছেপূরণের চেষ্টা করেছেন। মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীর হাত ধরে,  ছেলেকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য মায়ের প্রার্থনা পর্যন্ত স্বীকার করেছেন।

সতীদাহ রুখে দিয়ে রামমোহন যে সংস্কারের সূচনা করেছিলেন, তার পরিসমাপ্তির দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর আইন পাশের পরে,  কালীমতী দেবীর সাথে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের আইনসম্মত বিধবা বিবাহে রামমোহনের ছেলে রমাপ্রসাদের ইচ্ছাকৃত অনুপস্থিতি তাঁকে সমাজের প্রকৃত অবস্থান সম্বন্ধে বোধোদয় করিয়েছিল। সেদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত, এই বাংলা যে তাঁকে বুঝতে ও যোগ্য সম্মান দিতে  চূড়ান্ত ব্যর্থ, তার সূচনা সম্ভবত সেদিনই রচিত হয়েছিল। 

Continue Reading