গল্প
শ্রেয়সীর হাত রুকসানার হাতে…সূর্য অস্ত যাচ্ছে…দুজনেই তাকিয়ে নতুন দিনের আশায়
মেহেরবানী
কাকলি দেবনাথ
হ্যালো…।
ম্যাডাম, আমি প্রবীর বলছি।
প্রবীর শ্রেয়সীদের গাড়ির ড্রাইভার। ছুটি-ছাটার দিন টুকটাক এদিক ওদিক থেকে কোন এক্সট্রা ভাড়া পেলে প্রবীর চলে যায়। শ্রেয়সীও এইটুকু ছাড় দিয়ে রেখেছে। এই শুক্রবারে একটা পার্টিকে নিয়ে দীঘা যাবে বলেছিল। রাতে ফিরে ফোন করার কথা ছিল প্রবীরের। আজ থেকে মেয়ে তিতিরের আই সি এস সি পরীক্ষা শুরু। অক্সিলিয়াম কনভেন্টে পড়ে তিতির। প্রবীরের ফোন না আসায় শ্রেয়সী একটু দুশ্চিন্তায় ছিল। ফোনটা পেয়ে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে শ্রেয়সী বলল,
হ্যাঁ প্রবীর বলো…
ম্যাডাম। আমি বাড়ি ফিরতে পারিনি। রাস্তায় আটকে গেছি।
কেন? কী হল? শ্রেয়সী উদ্বিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করল।
চারদিকে খুব গন্ডগোল হচ্ছে ম্যাডাম ওই যে সরকার কি সব বিল পাশ করেছে না তাই নিয়ে।
শ্রেয়সী চোখের সামনে অন্ধকার দেখছে, উত্তেজিত হয়ে বলল,
মানে? কী বলছ তুমি প্রবীর? আজ থেকে তিতিরের ফাইনাল পরীক্ষা। তুমি না এলে, ও কি করে পরীক্ষা দিতে যাবে?
ম্যাডাম, আপনি কিছু একটা ব্যাবস্থা করে নিন প্লিজ। এখান থেকে আমি সোজা স্কুলে পৌঁছে যাব। বলতে বলতে ফোনটা কেটে গেল।
শ্রেয়সী বুঝতে পারছে না এখন কি করবে? একবার ভাবল, সোহমকে ফোন করবে। সোহমের কথা মনে পড়তেই রাগে পা থেকে মাথার ব্রহ্মতালু অবধি জ্বলে উঠল। বেশ আছে মানুষটা। সংসারের সমস্ত ঝামেলা শ্রেয়সীর উপরে চাপিয়ে নিজে সাত সমুদ্র ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছে।
না, এখন মাথা গরম করলে চলবে না।শ্রেয়সী মনে মনে ভাবল, সবার আগে মেয়েকে সময় মত স্কুলে পৌঁছে দিতে হবে। তাড়াতাড়ি সব কাজ গুটিয়ে নিল সে। তারপর তিতিরকে বলল, চটপট তৈরি হয়ে নিতে। বেশ খানিকটা সময় হাতে নিয়েই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শ্রেয়সী।
২
অটো-স্ট্যাণ্ডে খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর একটা অটো আসতে উঠে পড়ল ওরা। অটোর পিছনের সিটে একজন বোরখা পরা মহিলা আগে থেকেই বসেছিল। প্রেগনেন্ট মহিলা। যদিও বোরখা পরা তবুও শ্রেয়সীর মনে হল সাত আট মাস হবে। মহিলাকে দেখার পর থেকে শ্রেয়সীর মাথা আবার গরম হয়ে উঠল। এই এদের জন্যই যত ঝামেলা এদেশে। শ্রেয়সী যখন কলেজে পড়ত তখন রাম মন্দির, বাবরি মসজিদ নিয়ে সারা দেশ তোলপাড়। চার দিকে শুধু গণ্ডগোলের খবর। কলেজের একটা টেস্ট সেই সময় ট্রেন বন্ধের জন্য শ্রেয়সী দিতে পারেনি। আজ এত বছর পর তার মেয়ের পরীক্ষার সময় সেই এক ইস্যু নিয়ে ঝামেলা। আর কত দিন যে এই হিন্দু মুসলিম নিয়ে ঝামেলা চলবে এদেশে, ভগবানই জানে।
শ্রেয়সীদের বাড়ির কাছে একটা মুসলিম বস্তি আছে। মাঝে মাঝেই ওদের ওখানে মাইক বাজিয়ে ওরা ধর্মীয় সভা করে, অনেক বার ওদের মাইক বাজাতে বারণ করা হয়েছে। ওরা শোনে না। ওদের দেখাদেখি পাশের হিন্দু কলোনির ছেলেরা সকাল থেকে ফুল ভল্যুমে রাম-গান চালিয়ে রাখে। ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার কত যে অসুবিধা হয় এতে, ওরা তা বোঝে না।
পাশে বসা মুসলিম মহিলা নড়ে উঠল। ওর কি খুব কষ্ট হচ্ছে? শ্রেয়সী যতটা সম্ভব মহিলার ছোঁয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে।বড্ড বিরক্ত লাগছে ওর। এইভাবে অটোতে চড়ার বহুদিনের অভ্যেস নেই। কেমন গা ঘিনঘিন করছে। বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে শ্রেয়সী। রবীন্দ্র নগরের বাজারের কাছাকাছি আসতেই অটোটা দাঁড়িয়ে পড়ল। বিশাল জ্যাম।
কী হয়েছে? শ্রেয়সী ব্যাগ্র হয়ে জিগ্যেস করল।
সামনে বিরাট মিছিল। উল্টো দিক থেকে আসা অটো থেকে একজন বলল।
কিসের মিছিল দাদা?
ওই যে কিসব বিল পাশ করেছে সরকার। সেই সব নিয়ে।
শ্রেয়সীর বুকটা কেঁপে উঠল। তাহলে কি হবে এখন? অটোর ড্রাইভারকে বলল,
ভাই আমার মেয়ের ফাইনাল পরীক্ষা। অন্য কোন রাস্তা দিয়ে অটোটা নিয়ে চল প্লিজ।
দিদি অন্য রাস্তায় অটো ঢুকতে পারবে না।
দেখ ভাই তোমায় বেশি টাকা দেব। যে ভাবেই হোক তুমি আমাদের স্কুলে পৌঁছে দাও।
তিতির ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছে।
মা আমি পরীক্ষা দিতে পারব না?
ভাই একটু দেখ না। কোন ভাবে যদি…
আরে দিদি দেখছেন তো সামনে পিছনে কত বড় লাইন। কীভাবে অটো বের করব?
শ্রেয়সী পিছনে তাকিয়ে দেখল, সত্যিই তাদের অটোর পিছনেও লম্বা লাইন পড়ে গেছে।আশেপাশে বেশ কয়েকটা পুলিশের গাড়িও চোখে পড়ল শ্রেয়সীর। তাহলে কি বড় কোন ঝামেলা হতে পারে? কী করে বেরোবে এখান থেকে সে মেয়েকে নিয়ে? কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। শ্রেয়সীর অবস্থা দেখে পাশে বসা মহিলাটি মুখ থেকে বোরখার ঢাকা খুলে ফেলেছে। শ্রেয়সী বোধহয় কেঁদে ফেলবে এবার। এমন সময় মুসলিম মহিলাটি বলল,
এদিকে ভিতর দিয়ে ভিতর দিয়ে একটা পায়ে চলা রাস্তা আছে। আমি চিনি। আমার খালার বাড়ি এখানে। বেশ কিছুটা গেলে বড় রাস্তায় পড়বে। চল আমি নিয়ে যাচ্ছি তোমাদের।
কথাটা শোনার পরই শ্রেয়সীর মনে হল হাতে যেন চাঁদ পেয়েছে কিন্তু পরক্ষনেই মনের ভেতর কু ডাকল। মহিলার শরীরের যা অবস্থা কিভাবে নিয়ে যাবে ও আমাদের? সত্যিই প্রেগনেন্ট তো? নাকি এটা একটা ট্র্যাপ। আজকাল চারিদিকে যা সব ঘটছে। মনের ভেতর কেমন যেন সন্দেহ হয় শ্রেয়সীর। এই জায়গাটা পুরো মুসলিম এরিয়া। ওর অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই তো? শ্রেয়সী আর একবার ভালো করে মহিলাটির দিকে তাকাল। পেটটা কেমন ঝুলে আছে না! দাদু বলত,
ওরা মীরজাফরের জাত। ওদের বিশ্বাস করতে নেই।
শ্রেয়সী কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ওদিকে তিতির ক্রমাগত কেঁদেই
শ্রেয়সী মহিলাটিকে বলল,
চলো দেখি কি রাস্তা আছে।
মহিলাটির নামতে কষ্ট হচ্ছে। শ্রেয়সীর মন থেকে এখন ঘিনঘিনে ভাবটা উধাও হয়েছে। সে হাত ধরে নামাল তাকে। মহিলা আস্তে আস্তে আগে আগে চলছে। শ্রেয়সীর ইচ্ছে করছে, ঝড়ের গতিতে এক দৌড়ে রাস্তাটা পার করে দেয়। কিন্তু মহিলা জোরে হাঁটতে পারছে না। হাঁটতে হাঁটতেই ওরা টুকটাক কথা বলছিল। মহিলাটির নাম রুকসানা। ওর আগে দুটো মেয়ে আছে। এখন ন’মাস চলছে। খুব ইচ্ছে এবার একটা ছেলে হোক।
শ্রেয়সী না থাকতে পেরে জিগ্যেস করল,
এই অবস্থায় তুমি একা একা বেরিয়েছ কেন?
কি করব বিবিজি? ঘরে তো কেউ নেই। স্বামী রাজমিস্ত্রীর জোগালির কাজ করে। বাইরে বাইরে কাজে যায়। এক দু মাস বাদে বাদে ফেরে। বাচ্চা হলে তো কিছুদিন বাড়িতে থাকতেই হবে। তাই এখন একটু পয়সা জমিয়ে নিচ্ছে। সামনে কত খরচ।
তোমার মেয়ে দুটোকে কোথায় রেখে এসেছ?
পাশের বাড়িতে রেখে এসেছি। আমাদের বস্তিতে সবাই সবাইকে সাহায্য করে।
তিতিরের কান্না এখন বন্ধ হয়েছে, শ্রেয়সী মেয়ের মাথায় একবার হাত বোলাল,যাক মেয়েটার নার্ভাস ভাবটা এখন আর নেই।
শ্রেয়সীকে তিতিরের মাথায় হাত বোলাতে দেখে রুকসানা বলল,
জান বিবিজি আমার খুব ইচ্ছে আমার দুই মেয়ে বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে নোকরি করুক। আমার তো খুব ছোটো বয়সে শাদি হয়ে গেছে। পড়া লেখা তেমন কিছু শিখিনি। ওরা যেন শেখে।
তুমি তো খুব ভালো বাংলা বলতে পারো।
শ্রেয়সী হেসে বলল।
হাঁ, বাঙ্গাল তো আমার মাতৃভুমি হচ্ছে। আমার মায়ের জন্মও এখানে, আমারও এখানে জন্ম।
কথা বলতে বলতে ওরা হাঁটলেও শ্রেয়সী ভয়ে ভয়ে রাস্তার দু পাশে নজর রাখছিল। আবার কোন গণ্ডগোল না শুরু হয়ে যায়। নিজের দেশের রাস্তায় দিনের বেলা হাঁটতেও কেন এত ভয় ? শ্রেয়সী নিজেই নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করল। হাতে আর মাত্র কুড়ি মিনিট বাকি। শ্রেয়সী মন প্রাণ দিয়ে হনুমান চালিশা জপ করতে থাকল। খানিকক্ষণ পরে ‘হে আল্লা‘ বলে রুকসানা কঁকিয়ে উঠল।
কি হল? শ্রেয়সী তাড়াতাড়ি এসে রুকসানাকে ধরল।
রুকসানা প্রচন্ড ঘামছে। মুখ কুঁচকে বসে পড়ল সে।
বহুত দরদ হচ্ছে বিবিজি।
শ্রেয়সীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। সে তো কিছুই চেনে না এখানকার। বড় রাস্তাই বা আর কত দূর? তিতির প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। ও দিকে রুকসানাও ব্যাথায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। শ্রেয়সীর হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা, হান্ড্রেড ডায়াল করলে নাকি পুলিশ চলে আসে। সে হান্ড্রেড ডায়াল করল। না, কিচ্ছু হচ্ছে না । শুধু বিপ বিপ শব্দ। শ্রেয়সী এদিক ওদিক পাগলের মত ছোটাছুটি করতে থাকল। দু দিকে উুঁচু উুঁচু দেওয়ালের মাঝে সরু সরু গলি । কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কেঊ আছেন বলে শ্রেয়সী চেঁচিয়ে উঠল। মায়ের দেখা দেখি তিতিরও কাঁদতে কাঁদতে চেঁচাতে থাকল,
কেঊ আছেন…
কারও সাড়া নেই। একটা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ লোক মাথায় মুসলমানি টুপি পরে আসছিল। তাকে দেখে শ্রেয়সী জিগ্যেস করল,
দাদা বড় রাস্তা এখান থেকে কত দূর?
লোকটা সরু চোখে একবার শ্রেয়সী, একবার তিতিরের দিকে তাকাচ্ছে। চাওনিটা ঠিক ভালো লাগছে না। শ্রেয়সী একটু সরে দাঁড়াল যেন রুকসানাকে দেখা যায়। লোকটা পানের পিক থু করে ফেলে গম্ভীর মুখে বলল,
এই তো কাছেই।
শ্রেয়সী আর তিতির তাড়াতাড়ি রুকসানাকে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দুজনে মিলে বড় রাস্তার দিকে নিয়ে চলল। একটা অটো আসছে। অটোটাকে দাঁড় করিয়ে তিনজনে মিলে উঠে পড়ল।
কোথায় যাবেন? অটোওয়ালা জিগ্যেস করল।
শ্রেয়সী চটপট বলল, অক্সিলিয়াম কনভেন্ট।
তিতির বলল, না মা, আগে হসপিটাল।
রুকসানা চোখ বন্ধ করে বসে আছে।
শ্রেয়সী একবার রুকসানার দিকে তাকাল।
ড্রাইভার চলতে চলতে আবার জানতে চাইল, ঠিক করে বলুন কোথায় যাবেন?
আগে হসপিটাল চলুন। শ্রেয়সী বলল।
৩
হসপিটাল বেডে শুয়ে আছে রুকসানা। ওর বাড়ির লোকজনকে খবর দিতে পারেনি শ্রেয়সী। নার্স এসে খবর দিয়ে গেল, রুকসানা খাতুনের বাড়ির লোক পেশেন্টের সঙ্গে দেখা করতে পারে। শ্রেয়সী আস্তে আস্তে এসে রুকসানার বেডের পাশে দাঁড়াল। রুকসানার হাতে হাত রেখে বলল,
তোমার ছেলে হয়েছে।
রুকসানা ক্লান্ত চোখে শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে বলল,
বিবিজি আমার জন্য বহিনের পরীক্ষা দেওয়া হলো না। রুকসানার চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
শ্রেয়সী রুক্সানার চোখের জল মুছিয়ে বলল,
ধুর পাগলি, তিতির তো পরীক্ষা দিতে পেরেছে। তোমাকে এখানে অ্যাডমিট করিয়েই আমি তিতিরকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছি। তোমার দেখানো পথ দিয়ে এসেছিলাম বলেই তো তিতির সময়মত পৌঁছতে পারল। খুব ভালো পরীক্ষা হয়েছে ওর। আমার ড্রাইভার ওকে বাড়ি নিয়ে গেছে।
আনন্দে উজ্বল হয়ে উঠল রুকসানার মুখ।
নার্স রুকসানার ছেলেকে ওর পাশে শুইয়ে দিয়ে গেছে। রুকসানা ছেলের দিকে তাকিয়ে ছেলের মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
বিবিজি, আপনার জন্যই আজ আমার ছেলে পৃথিবীর আলো দেখল।
শ্রেয়সী রুকসানার হাতে হাত রাখল। রুকসানাও শ্রেয়সীর হাতটা নিজের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখল। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সুর্য অস্ত যাচ্ছে। ওরা দুজনেই তখন নবজাতকের দিকে তাকিয়ে আছে নতুন দিনের আশায়।
গল্প
ভোর আর সমুদ্র মিলেমিশে একাকার…হঠাৎ বাজে সেলফোন…হাওয়া আর সাগরের ছন্দে বেমানান হয়ে ওঠে রিংটোন
পরিযায়ী
মানস সরকার
গল্প
উলঙ্গ রাজার শরীরে পোকা সে দেখেও দেখে না

চন্দন চক্রবর্তী
জুজু
বছর তিনেক হল এই আবাসনে এসেছি৷ ভীষণ সুন্দর৷ বারোতলা করে বিল্ডিং৷ সাতটা ব্লক৷ আমি ‘বি’ ব্লকে থাকি৷ করোনার প্রকোপে বাড়ি থেকে অফিস বন্ধ,ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে৷ লকডাউনেও রোগটা বেশ ছড়িয়ে পরেছে৷ নীচে বিশেষ নামা যাচ্ছেনা৷ তাই বারতলার টেরাসে এসেছিলাম৷ একটু পায়চারি করার উদ্দেশ্যে৷ উফ কী সুন্দর আামার শহর৷ অনেক আলোর ঘরবাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে৷ সবার মাথায় চেপে বসে আমি৷ সাঁঝবেলায় অন্ধকারে এক অপূর্ব মাধুর্য জড়ানো থাকে৷ সেটা জড়িয়ে শহর দেখছিলাম৷ কোনও দিন এভাবে একা শহর দেখা হয় নি৷ আজ সেই সময় সুযোগ পেলাম৷
হঠাৎ কে যেন আমার পাশে বসে পড়ল৷ আমি বুঝতে পারছি কেউ বসল৷ কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা৷
ও বলল,‘কাকে খুঁজছো?আমাকে?’
আমি একজন সাংবাদিক এবং একটি নামি বাংলা দৈনিকের সম্পাদকও বটে৷ প্রেসিডেন্সি থেকে মাস্টারস করে সাংবাদিকতা শুরু করি৷ এখন সম্পাদক৷ সুতরাং অনেক কিছু দেখা৷ কিন্তু এরকম কখনও দেখিনি কেউ পাশে এসে বসল অথচ সে দৃশ্যমান নয়৷ ভূত প্রেত এর নাম শুনেছি কিন্তু একেবারেই বিশ্বাস করিনা৷ হ্যাঁ, উপনিষদের আত্মা-তত্ত্ব মানলে আাত্মা বিদ্যমান কিন্তু দেখা যায় না৷ কাঠের মধ্যে অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো৷ তাহলে এটা কি কারও আত্মা৷ ব্যাটা ছাদে আমাকে একা পেয়ে গেঁড়ে বসেছে৷কার আত্মা? কে সে? দেখা যাক ব্যাটা কী বলতে চায়৷
‘তোমাকে খুঁজতে যাব কেন? তোমার তো অস্তিত্বই নেই৷ যাই হোক এসেই পড়েছ যখন তখন বলে ফ্যালো তুমি কে? কেনই বা এসেছ? আমার মাথাটা একটু হাল্কা করতে দাও৷ কালকের পেপারের কিছু কাজ এখনও রয়ে গেছে,যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷
ধরোনা কেন তোমাকে সেই ব্যাপারেও সাহায্য করতে পারি৷
সময় নষ্ট না করে বলো তুমি কে?
আমি দৃশ্যমান নই তবুও ছোট্টবেলা, মাঝবেলা,বুড়োবেলাতেই আমি থাকি৷ আমার নাম করে তোমাদের ভয় দেখাত৷ আর এখন এই বয়সে সত্যিই ভয় দেখাই৷
কে হতে পারে ! এতো দেখি মেমরি গেমে ফেলে দিল৷তবে বেশ মজা পেলাম৷ ছোট্টবেলায় খেতে না চাইলে বা ঘুমোতে না চাইলে মা বলতো ‘ওই হাম্বা আসছে’ অথচ তখন হাম্বা বলে কিছু চিনতাম না৷
ইতস্তত করে বলি,‘তুমি কি হাম্বা নাকি?’
ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসে৷
‘যা বাবা শেষে হাম্বা!’
‘ভাবো,ভাবো,ভাবতে থাকো৷
‘শোন আমার ভেবে কাজ নেই৷ আমার বলে চাকরির চিন্তায় মরছি৷ তুমি ফুটে যাও৷’
‘কী ভাবছ? চাকরি চলে যাবে? এই করোনা পিরিয়ডে দেশের ইকোনমি তলানিতে৷ সুতরাং কর্মী ছাঁটাই চলবে৷মাইনে কমিয়ে দেবে ইত্যাদি তাইতো!’
কিছুটা বমকে গেলাম৷ ব্যাটা বলে কি?
কিছুটা তো ঠিক৷ কিন্তু খবরের কাগজ চালানো দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে৷এভাবে চলতে পারে না৷
লোকটার গলার স্বর গাড় হল৷ কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা মনে হতে লাগল৷ অথচ আমি পোড় খাওয়া একজন সাংবাদিক কেমন ভেতর ভেতরে ঘাবড়ে গেলাম৷
আমোঘ বাণী শোনাবার মতো করে বলল,
‘চালাতে হবে, মালিক যা চাইবে তাই করতে হবে… না হলে ছোটবেলার সে এসে ঘাড়ে চাপবে৷ ছেলেপুলে নিয়ে সংসার করো, কী লাভ ওসব করে?’
তা বলে সংবাদ মাধ্যমের বা সাংবাদিকের নীতি আর্দশ? সব সমালোচনা করাই তো আমাদের মৌলিকতম কর্তব্য! আরে বাবা গনতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে কথা৷সরকারের নেতাদের ভুলত্রুটি তুলে ধরা থেকে সরে আসা যায়?
‘ধুত তেরি!এতো দেখি একেবারে আবোধা! নিজের ভালো নিজে বোঝেনা?’
শোন ‘কুর্শিকে কখনও প্রশ্ন করতে যেওনা৷ তাকে কুর্নিশ করতে শেখো৷ না হলে, কিন্তু যতই ক্ষমতাবান লেখক,কবি,সাংবাদিক হওনা কেন, এমন কেসে ফাঁসাবে বাপ্ বলার সুযোগ পাবেনা৷ সোজা ফাটকে!
‘তাই বুঝি, দেশে কি আইন কানুন নেই নাকি?
আবার ফ্যাক ফ্যাক হাসি৷ হাসির শব্দটা কানে ঢুকে সমস্ত শিরা উপশিরা ধরে মাথায় চলে যাচ্ছে হাসিতেও কেমন এক বদ গন্ধ, শরীরে পাক মারছে সেই পুতি গন্ধ!
এবারে হাসি থামিয়ে অদৃশ্য মানুষটি বলে,‘আইনকেও প্রশ্ন করোনা৷ দিনকাল খারাপ৷’
বুঝলাম,তা কী করতে হবে?
এসো, পথে এসো, ঘরে গিয়ে কাগজের হেডিংগুলো পরিবর্তন করো৷ যেগুলো ক্ষিতকারক অথচ বড় হরপে দেওয়ার কথা সেগুলো চেপে যাও৷ নতুবা, ছোট্ট করে শেষের দিকে কোথাও গুঁজে দাও৷ মোদ্দাকথা প্রো-সরকার কথাবার্ত্তা লেখ৷ দরকার হলে গলায় ঘন্টি বেঁধে তা বাজাও৷ না হলে কিন্তু…’
শালা!তুমি কি সুপারি কিলার নাকি? কত সুপারি পেয়েছিস, ব্যাটা ?বললে,‘তোমার বাড়িতে বহু সুপারি চলে যাবে৷ পায়ের ওপর পা তুলে খাবে৷ দশবার বিদেশে কাজে অকাজে যাবো৷ জীবন রঙিন হয়ে যাবে৷’
শরীর থির থির করে কাঁপতে থাকে৷লোকটি কে সামনে আসছেনা কেন? পরিচয়ও দিচ্ছেনা৷ কে পাঠিয়েছে? বেশ কিছুক্ষণ ওর শব্দ নেই৷ স্ল্যাবে বসে ছিলাম৷ উঠে আধো অন্ধকারেই খুজতে থাকি৷ ওপাশে একটা ঢাকা অংশ আছে৷ বিস্তর ময়লা জমেছে৷ ওখানেই কি গা ঢাকা দিল৷ এখন তো মনে হচ্ছে না, ব্যাটা আমার সঙ্গে আছে৷ যাকেগে্ বাঁচা গেছে৷ তবে এটুকু মনে আছে রাজা যখন কলকাতায় এসে সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন তখন হাততালির বন্যায় ভেসে যাচ্ছিলেন৷ তখন মনে মনে উচ্চৈস্বরে প্রশ্ন করেছিলাম কবির ভাষায় ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ সেটা কীভাবে রাজা শুনেছিলেন জানিনা৷ শুধু বলেছিলেন ‘প্রশ্ন করা যাবেনা’৷
সেই ভেতর প্রশ্ন আমাকে এখন তাড়া করে বেড়ায়৷ যেই কুর্শিতে বসুক৷ যত সুন্দর তা হোকনা কেন সব সময় মনে হয় রাজা উলঙ্গ৷ তার শরীরে সজস্র পোকা কিলবিল করে ঘুরছে৷ সে দেখেও দেখেনা৷ বুঝেও বোঝেনা৷ আবোধার মতো হাসে৷ সেই বোধ কলমে বেরিয়ে আসে৷ কিন্তু একা কি পারবে এই নকল বুধি গড়কে রক্ষা করতে৷
যাকগে, এসব ভেবে লাভ নেই, হয়তো ভুলভাল ভেবে চলেছিলাম৷ অথবা রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীদের হয়ে কাজ করবার মানসিকতা আমার ভিতর মনে ঢুকে যাচ্ছে৷ আর সেটাই চেতন মনে জ্বালাতন করছে৷
ছাদের প্যারাপিটের কাছে দাঁড়াই৷ উফ্, কত সুন্দর কলকাতা! অথচ এই সুন্দরের মধ্যে কত কীট! কলকাতাকে কুরে কুরে খাচ্ছে৷ তাদের কাজই ধ্বংসাত্মক৷ কিন্তু তাদেরও তো খাদ্যের প্রয়োজন! তবে যে লোকটা এসেছিল সে কি আমাকে ‘খাদ্য’ ঠাউরেছে! সর্ম্পকটা কি তবে খাদ্য এবং খাদকের৷ খাওয়ার আগে কিছু জ্ঞান দিয়ে দিল৷ যেমন যুদ্ধের আগে এক ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ হুমকি খেলা! ওই একটা হুমকিতে দেশের মানুষকে বশ করা যাবে!
লোকটি, কি আছে? নাকি ভেগেছে? কিন্তু জানা হলোনা ওর আসল পরিচয়টা কী?
দু’বার পায়চারি করলাম৷ বেশ ভালো লাগছে৷ মাথার উপর আকাশটা কত কাছে৷ রূপোলি আলোয় আলোময়৷ তারা ঝিকমিক৷ কোন গ্রহে এখনও প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায়নি৷ ভাগ্যিস, মানুষের মতো কোন প্রাণী জন্মায়নি৷ নিজেদের আধিপত্য বজায় করার জন্য ‘ভাইরাস’ যুদ্ধ ভাবা যায়৷ বাহ এখান থেকে নীচের পথ ঘাট গাছপালাও কত দূরে৷ আমি যেন মাঝে দাঁড়িয়ে৷ যেখানে খুশি চলে যেতে পারি৷ কিন্তু চিন্তার আবার লোকটা এসে পড়ে৷ এই লোকটা তো বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের সুপারি দানার হুমকি দিতে পারে৷ শালা,যত হুজ্জুতি সাধারণ মধ্যবিত্ত, গরিবের ওপর৷ পাক্কা, শুয়োরের বাচ্চা! চোখ ঘুরিয়ে দেখছি রাতের কলকাতা৷ এবারে খোঁজার চেষ্টা করি৷ আমাদের অফিসটাকে৷ হুঁ,সোজা উত্তরদিকে…ফ্লাই ওভার বরাবর গেলে…নাহ এত বড় শহরে আমার অফিসটা৷ আমার ঘরটা কেমন হারিয়ে যাচ্ছে৷ আবার একটু অস্থির হয়ে পড়ি৷ মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে৷ কিযে হল! লোকটা এসে সব গোলমাল করে গেল? লোকটা গেছে তো? নাকি ঘাপটি মেরে আছে কোথাও৷ যদি হাতের কাছে পেতাম ব্যাটাকে পিটিয়ে তক্তা করে ছাড়তাম৷ জেলের ঘানি টানাতাম৷
হঠাৎ কানের কাছে গম্ভীর গলায় বলল, ‘ঘানি টানাতে হলে আদালতে যেতে হবে…৷ এইটুকু বলে বিকটভাবে হাসতে থাকে৷
হ্যাঁ যাব, সুপ্রীম কোটে যেতে হলে তাই যাব৷
ওখানেও তো ‘জুজু’ বসে আছে৷
মানে?
মানে আবার কি? এটাতো আমার কথা নয় তোমাদের বঙ্কিমচন্দ্রই বলে গেছেন-‘কাঠগড়ার ভিতরে বিড়ে মাথায় সরকারি জুজু বসিয়া আছে,’তখন সেই জুজু কোর্টের কুর্শি ছাড়া চিনত না, এখন রাজশক্তির কুর্শি চিনে গেছে বুঝেছ৷ তাকে কুর্নিশ করা প্রথম এবং প্রধান কাজ৷ আমর ঘেঁচু করবে৷…তার চেয়ে বল, তুমি কী ভাবলে? সুপারি খাবে নাকি নেবে?
দুম করে মাথায় আগুন জ্বলে উঠল
নিকুচি করেছে সুপারির৷ তুই কোথায় আছিস বল? তোকে আজ ছাড়বোনা আমি৷
‘তোমার সামনে পিছনে ভিতরে আছি’৷
একটা লাঠি পড়ে ছিল সামনে৷ সেটা নিয়ে এলোপাথাড়ি চালাতে লাগলাম৷ আর ও ব্যাটা ছুটে বেড়াতে লাগল৷আমিও বন বন করে ঘুরছি৷
হঠাৎ সুপর্ণা ছাদে উঠে এল৷ সে আঁতকে উঠল৷
‘ছাদ থেকে ঘুরে আসছি বলে এতক্ষণ কী করছ? ওদিকে চা জুড়িয়ে গেল’!
তখন আমি লাঠিটা ফেলে দিয়ে বসে পড়েছি৷ হাঁফাচ্ছি৷ ঘাম ঝরছে৷ ও আমার পাশে বসে বলে,
‘কী হয়েছে তোমার?কার পিছনে দৌড়োচ্ছিলে?’
বললাম, লোকটা আমাকে ক্রমাগত ভয় দেখাচ্ছিল৷ সে দৃশ্যমান নয়৷ ‘তারমানে কে সে’?
হঠাৎই টেরেসের ছাদ থেকে অদৃশ্য লোকটা বলল,
‘অর্কবাবু আমাকে চিনতে পারলে না?’আমি জোর গলায় চিৎকার করি – ‘না-আ..আা…কে তুমি?’
হো হো হাসি আকাশময়৷
আমি সেই ছোটবেলার জুজু৷ এই বয়সেও সেই জুজু!আমার কোনও অস্তিত্ব নেই৷ তবুও আমি জুজু৷…আমার কাজ ভয় দেখানো৷ ভয় পেলেই গেছ৷
শুয়োরের বাচ্চা! আমি কোনও জুজুকেই ভয় পাইনি৷ ফোট্ এখান থেকে৷
সুর্পনা কিছু বোঝার আগে বললাম,
‘চলো, খবরের কাগজের কালকের ইসুর জন্য অনেক কাজ জমে আাছে’!




