প্রবন্ধ
হেইমেনডর্ফ আবিষ্কার করেছিলেন ওয়ানচু আর কোনিয়াক এক
আত্মীয়তার চোরাটান
শ্যামল ভট্টাচার্য
নৃতাত্ত্বিক হেইমেনডর্ফ দীর্ঘ দিন অরুণাচল প্রদেশে থেকে গবেষণা করেছেন
সংস্কৃতির সাক্ষ্য দিয়ে জাতিকে চিহ্নিত বা সনাক্ত করা একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক হেইমেনডর্ফ এক সন্ধ্যায় অতিথি হয়েছিলেন অরুণাচলের ওয়ানচু গ্রামে। সন্ধ্যেবেলায় নাচের আসর জমে। ওই গ্রামের সব যুবতী মেয়ে সেজেগুজে একদিকে দাঁড়ায়। পাশের গ্রাম থেকে আসা একদল সুঠাম যুবকও সেজেগুজে আর একদিকে দাঁড়ায়। ছেলেগুলি এবার গান গেয়ে মেয়েদেরকে বলে, “দেখ আমরা কেমন সুদর্শন, মেয়েরা আমাদের রূপ দেখলে পাগল হয়ে যায়। চলে এসো আমাদের কাছে।” মেয়েরা বলল, “সুদর্শন না ছাই, বয়েই গেছে তোমাদের কাছে যেতে!” ছেলেগুলি গাইল, “ইশ, কত না রূপের বাহার, যাও না যারা ঝাঁপিয়ে পড়বে তাদের কাছে!” ছেলেগুলি তখন যাওয়ার ভান করে বলে, “তাহলে যাই আমরা!” মেয়েরা তখন গায়, “আহা রাগ করছ কেন? আমরা কি যেতে বলেছি? বসো আমাদের দাওয়ায়!”
এই অনুষ্ঠানের পরই হেইমেনডর্ফ এক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ঘোষণা করলেন। আবিষ্কারটা হল এই যে ওয়ানচু জনজাতি আর কোনিয়াক ট্রাইব আসলে একই ট্রাইব। শত শত বছর ধরে এই একই গান ওরা পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুটো ভিন্ন জায়গায় বাস করে গেয়ে চলেছে! এই গল্প আমি পড়েছি কবি উদয়ন ঘোষের লেখায়। উদয়নদা অনেক ভাষা জানেন । বিভিন্ন ভাষা থেকে অনুবাদও করেছেন প্রচুর । শিলঙের কলেজ থেকে অবসর নিয়ে তিনি এখন কলকাতার বাসিন্দা । বছর দশেক আগে হাইলাকান্দি থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকার ৪৪তম জন্মদিবসে উদয়নদার সঙ্গে হাইলাকান্দি গিয়েছিলাম। আসা-যাওয়ার পথে ট্রেনে, বাসে এবং হাইলাকান্দি সার্কিট হাউসের ঘরে তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক কথা হয়েছে । আমরা দু ‘ জনেই উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষ। এই অঞ্চলে নানা ভাষা জাতি ও জনজাতির বাস। নিয়মিত সহবাসে হঠাৎ করে নানা শব্দে ও ধ্বনিতে আমরা আত্মীয়তার চোরাটান অনুভব করে শিহরিত হই।
এবার গল্প পড়ুন বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের কলমে
আগের বার আগরতলায় সাহিত্য অকাদেমির একটি অনুষ্ঠানে ডিমাছা কবি সুদীপ্তা খেরসা আমাকে বলেছিলেন যে ডিমাসা মানে নদীর সন্তান। ডি মানে নদী বা জল, আর মাছা মানে সন্তান। আমি জানি মণিপুরি মৈতৈ ভাষায় সন্তানকে বলে ‘মচা’ আবার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক নদীর নাম শুরু হয় ডি দিয়ে। ডিবং, ডিগারু, ডিখৌ, ডিহিঙ ইত্যাদি। অনেক কাল আগে ডিমাছাদের রাজধানীও ছিল ডিমাপুরে। খাসি কবি কিনফাম সিং ননকিংরি বলেছিলেন, খাসিরা পান করাকে বলে ডি। জল পান করাকে বলে, ডি উম। উম মানে জল। ননকিংরির স্ত্রী বাঙালি। তিনি আমাকে বোঝান যে খাসিতে যে কোনও শব্দের আগে স্ত্রীবাচক ‘কা’ কিংবা পুংবাচক ‘ উ ‘ লাগাতে হয়। মানুষের জীবনধারনের জন্য জলের প্রয়োজন অপরিসীম। সেজন্যে জলকে বলা হয় ‘কা উম্’ ।
চাঁদ খাসি কল্পনায় পুরুষের মতো কোমল, সেজন্যে তিনি ‘উ বনাই’। আর সূর্য খাসি মেয়েদের মতোই তেজি বলে তিনি ‘কা সিংগি’।সাঁওতালি কবি জাদুমণি বেসরা বলেছিলেন, সাঁওতালিতে সূর্যকে বলে সিংগি বোঙা ( সূর্য দেবতা ) । যে কোনও দেবতাকে সাঁওতালিরা বলে বোঙা । বাঙালিদের মতো সাঁওতাল এবং খাসিদের পূর্বপুরুষরাও অস্ট্রিক ছিলেন । সেক্ষেত্রে এ ধরনের আত্মীয়তা হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে পড়তেই পারে। সীতা যেমন পুষ্পক রথ থেকে অভিজ্ঞান স্বরূপ অলঙ্কার ফেলে ফেলে গিয়েছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষেরাও তেমনি কিছু কিছু শব্দ পথে পথে এমনভাবে রেখে গেছেন যে আমরা আত্মীয়দের চিনে নিতে পারি। খাসিরা গাছকে বলে,’ ডিয়েং’, গাছের ডাল , ছড়িকেও বলে ডিয়েং। বাঙালিরা গ্রামে গাছের ছোট ডাল নিয়ে যে ‘ ডাং ’ – গুলি খেলে সেই ডাং শব্দটাও তেমনি একটি অভিজ্ঞান।
পূর্বপুরুষেরা কিছু শব্দ রেখে গেছেন যা দিয়ে আত্মীয় চেনা যায়
উদয়নদার এক ভাগ্নে জীববিজ্ঞানী। তিনি ও তার ফিলিপিনো স্ত্রীর সঙ্গে কথায় কথায় উদয়নদা জেনেছিলেন ফিলিপিনো ভাষায় জলকে বলে ‘দা-উম’। আমাদের অস্ট্রিক আত্মীয় মুণ্ডারি ভাষায় জলকে বলে ‘দা’। ওরা দামোদর নদীর পাড়ে থাকত বলে নদীটাকে ডাকত ‘দা-মুণ্ডারি’ বলে। সেই থেকেই দামোদর নাম হয়েছে। আমরা যেমন ভয়-ডর, হাট বাজার, সলাহ-পরামর্শ ইত্যাদি সমার্থক শব্দ একসঙ্গে উচ্চারণ করি ফিলিপিনোদের ভাষায় জলের দুটো নাম ‘দা’ আর ‘উম’ একসঙ্গে উচ্চারিত হয়ে তেমনি জল বোঝায়।
ডিমাছাদের ‘ডি’, মুণ্ডারিদের ‘দা ফিলিপিনোদের ‘ দা-উম ’ এর মতো মণিপুরে কোথাও জলকে বলে ‘ তই ’ আবার অন্য কোথাও ‘ দই, আমাদের রাজ্যের ককবরক ভাষায় জলকে ‘ তুই’ বা ‘ তই’। মিজোরাও জলকে বলে ‘তুই’। আমার প্রিয় মিজো কবি জাইথাংপুই ওয়াংতু বলেছিলেন ওরা নদীকেও ‘তুই’ বলেন । ‘তুই ভাই’ মানে বিদেশি নদী। ‘ভাই’ মানে বিদেশি। উদয়নদার মতে ওই ‘তুই ভাই-ই’ আসামে এসে হয়েছে টিপাই নদী। ওই নদী যেখানে এসে বরাকে মিশেছে তাকে বলা হয় টিপাইমুখ।
দক্ষিণবঙ্গের মেদিনীপুর অঞ্চলে লাঠিকে বলে ‘ডাং’। খাসিরা লাঠিকে বলে ‘ডিয়েং’। পাহাড়কে বলে ‘লুম’। যে পাহাড়ের গাছ থেকে সমাজের সবাই জ্বালানি কাঠ নিতে পারে তাকে বলে ‘লুম ডিয়েং’। লামডিং জায়গার নাম হয়তো ওই ভাবেই এসেছে! নাগাদের ‘তই’, মিজোদের ‘ তুই ’ ককবরক ‘ ই , তাই ’ বা ‘ তয় ’ আর সংস্কৃতে ‘ তোয়’ । (পূণ্যতোয়া, স্বচ্ছতােয়া ) সবই তো জলের নাম। তবে নাগা, মিজো যারা সংস্কৃত ভাষার সংস্পর্শে আসেনি তারা জলের মতো এত প্রয়োজনীয় একটা জিনিসের নাম সংস্কৃত থেকে নিয়েছে, – এটা অসম্ভব মনে হয়! বরং উল্টোটাই হয়তো হয়েছে। মণিপুরিরা জলকে ইশিং বললেও জলের কলকে বলে ‘ততি’ আর নদীকে বলে ‘তুরেন’। তিব্বতি আর ভুটিয়ারা নদী আর জলকে বলে ‘ৎচু’।
এভাবে শব্দের সূত্র ধরে পুরনো আত্মীয়দের চিনতে পেরে অনেক সময় খুব আনন্দ হয়। এমনিতে উত্তর ভারতের প্রায় সমস্ত বড় ভাষাগুলির মধ্যে প্রচুর শব্দ হুবহু বা সামান্য পরিবর্তিতভাবে পাওয়া যায়। সংযোগরক্ষাকারী ভাষা হিসেবে হিন্দি ও উর্দু থাকায় আমরা এই ভাষাগুলির মধ্যে মিল পেয়ে তেমন অবাক হই না। কিন্তু বিদেশি কোনও ভাষায় আমাদের শব্দ শুনলে অবাক হতে হয়। উদয়নদার এক আত্মীয়া দিল্লিতে এক রাশিয়ান শিক্ষকের কাছে রুশ ভাষা শিখতেন। একদিন আগুন দেখে সেই মাস্টারমশাই উত্তেজিত হয়ে ‘ অগ্নি, অগ্নি’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। ছাত্রছাত্রীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কী বলছেন স্যার ?
এবার কবিতা পড়ুন বিশিষ্ট কবিদের কলমে
তিনি লজ্জিত হয়ে বলেন, ওহ ফায়ার , অগ্নি ইন আওয়ার ল্যাঙ্গুয়েজ!’ ছাত্রীরা বলে, ওটি তো আমাদের শব্দ স্যার ‘অগ্নি’ -সংস্কৃত থেকে এসেছে! তিনি বলেন, আরে, তোমাদের সংস্কৃত আমরা কখন কে জানে গোপনে শিখে নিয়েছি। আমরাও igneous = আগ্নেয়, ignite = অগ্নি সংযোগ এসব কত শুনেছি| বার্মিজরা মাছকে বলে, ‘ঙা’, মণিপুরিরাও বলে,‘ ঙা’। জাই বলেছিলেন, মিজোরা বলে ‘শা-ঙা ‘। শা মানে মাংস। শাঙা মানে মাছের মাংস। মণিপুরিতেও একই।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার গল্পে আমরা সবাই পড়েছি দক্ষিণ আমেরিকার ইনকা না কারা যেন সুতোর গিট দিয়ে গোপন সংকেতে তথ্য জমা করে রাখত। অনেক সোনার খনির খবর, অনেক ধনরত্নের খবর তাঁরা সুতোর সংকেতে রাখতে পারত। কিন্তু কেউ ওই কিপুর রহস্য ভেদ করতে পারছিল না। তাই ডাক পড়ে ঘনাদার। উদয়নদা বলেছিলেন, খাসিদেরও নাকি সুতোয় গিঁট দিয়ে দিয়ে গোপন সংকেতে অনেক তথ্য সঞ্চয় করে রাখা হত। কোথায় খাসি পাহাড় আর কোথায় দক্ষিণ আমেরিকার পেরু , ইনকা, ‘কিপু’। কী করে এই যোগসূত্র ছিন্ন হল?
খাসিদের কিছু কিছু পদবি মেদিনীপুরের জায়গার নামের সঙ্গে মেলে। যেমন ‘সাবং’।মেদিনীপুরে ‘সাবং’ আছে, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েও আছে। ছেড়ে আসা জায়গার স্মৃতির মায়ায় যেরকম নাম হয়েছে নিউইয়র্ক, ত্রিপুরার অনেক গ্রামের নাম, পশ্চিমবঙ্গের অনেক কলোনির নাম যেমন পূর্ববঙ্গ থেকে শরণার্থী হয়ে আসা মানুষজন নিজেদের গ্রামের স্মৃতির মায়ায় রেখেছেন, তেমনি মালয় কিম্বা ইন্দোনেশিয়া থেকে জীবিকার স্বার্থে আসা জনগোষ্ঠীর স্মৃতির মায়ায় প্রিয় ‘সাবং’ নামটিও মেদিনীপুর হয়ে পৌঁছে গিয়েছিল খাসি পাহাড়ে?নাকি উল্টোকিছু হয়েছিল? মেদিনীপুর যে আগে আন্তর্জাতিক নেীযাত্রার ঘাঁটি ছিল তা তো আমরা জানি! মেক্সিকোর মঙ্গোলয়েড আদিবাসীরা মানুষের মুখ বানায়। এক পাশে জীবিত আর অন্যপাশে মৃত মানুষের মুখ। পিকাসো ওই শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ হয়ে নিজেও ওই ধরনের কাজ করেন। ওরকম দুমুখো মানুষের নাচ আমরা নাগাল্যান্ডেও পাই। এসব শিল্পের স্বাক্ষর নিয়ে তাদের যোগাযোগ আবিষ্কার করতে আন্তর্জাতিক গবেষণার প্রয়োজন।
টেটন নামের এক পাজি দেবতার কথা ইউরোপে সবাই জানে। ত্রিপুরা , আসাম ও উত্তরবঙ্গের চা বাগানের শ্রমিকদের আপনারা জিজ্ঞেস করে দেখবেন টেটনের কথা জানে কি না, দেখবেন সবাই বলবে, হা হা জানি, টেটন তো ভীষণ শয়তান! ত্রিপুরার বাঙ্গালিরা পাকামি করাকে বলে ‘টেটনামি’ করা। এসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষ কি ইউরোপীয় সাহিত্য পড়ে এসব জেনেছে ? অসম্ভব। কত শতাব্দী আগে কোন পথে টেটন এদিকে এসেছে বা ওদিকে গেছে কে বলবে ? ২০০১ – এ কলকাতা বইমেলায় চিলি না পেরু কোন এক লাতিন আমেরিকার দেশ ছিল বিশেষ আমন্ত্রিত। ওদের প্যাভেলিয়নে ওদের দেশের এক প্রাচীন দেবীর ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল। ওই দেবীর খোলা চুল , গলায় মুণ্ডমালা, ন্যাংটো দাঁড়ানো উগ্রমূর্তি দেখে আমার মেয়ে প্রণাম করে বলেছিল, মা কালী! আসলে তিনি ওদের প্রাচীন দেবী । কে তাকে লাতিন আমেরিকায় নিয়ে গেল ? কবে ? কীভাবে ?
প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ কুমুদ কুণ্ড চৌধুরী ত্রিপুরার আদিভাষা ককবরকের লিখিত রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলা লিপির ব্যবহালের সপক্ষে বলেছেন। মঙ্গোলিয়ার বর্ণমালা বাংলা বর্ণমালারই পরিবর্তিত রূপ। মা তারা মঙ্গোলিয়ার আরাধ্যা দেবী। ওদের জাতীয় পতাকায় মা তারার ছবি। বাংলার বৌদ্ধ তান্ত্রিক সন্ন্যাসীরা তিব্বত পার হয়ে, চিন পার হয়ে সুদূরে নিয়ে গেছেন বাংলার ধর্ম আর সংস্কৃতি। স্কটল্যান্ড পার হয়ে প্রাচীন আইসল্যান্ডেও মা তারাকে পাবেন। কিছুদিন আগেও ইউরোপে তারা নামের অনেক মহিলাকে দেখেছেন ঢাকার কবি সৈয়দ আবদুল করিম।‘ উমা ‘ নামও তিনি ইউরোপে পেয়েছেন। হলিউডের একজন নামি নায়িকার নামও নাকি ‘উমা’।
প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুকুমার সেন তাঁর প্রবন্ধে অনেক ফটোগ্রাফ দিয়ে দেখিয়ে গেছেন যে, দুর্গাদেবী উমা, যিনি সিংহবাহিনী, তিনি ইরান থেকে আমাদের দেশে এসেছেন। কিন্তু শাকম্ভরী দুর্গা তো হরপ্পা যুগ থেকে এদেশেই ছিলেন। শাকম্ভরী আর সিংহবাহিনী পরবর্তী সময়ে কালের স্রোতে একাকার হয়ে গেছে। মঙ্গোল আর হুনরা হলুদ পতাকা, বেগবান ঘোড়া আর রক্তপিপাসু তলোয়ার নিয়ে বারবার ইউরোপের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে। ওরা শুধু সম্পদই লুণ্ঠন করেনি, নারীদের যৌবনও লুঠ করেছে। সেজন্যেই আজ ইউরোপে লক্ষ লক্ষ মঙ্গোলয়েড চেহারার মানুষ দেখা যায়| নিজেদের জিন ছেড়ে আসার পাশাপাশি হয়তো ওরা মা তারাকেও ওদিকে রেখে এসেছে, নাকি তাঁরা আগে থাকতেই ইউরোপে ছিলেন?
তারা ইউরোপে আগে থাকতেই ছিলেন? কোন পথে বাংলায় এসে মঙ্গোলিয়ায় গিয়ে যাত্রা শেষ করেছেন? শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে দক্ষিণের শহরের নামও মা তারা। সম্প্রতি ওই জেলায় এমপি নির্বাচিত হয়েছেন ক্রিকেটার সনৎ জয়সূর্য । ওদের মা তারা কি আমাদেরই মা তারা? বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরা নিয়ে গেছেন? সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপে গিয়ে শুনেছিলেন, একটা লোক বলছে, মাই বেলি, কাইকাই অর্থাৎ আমার পেটে খাই খাই (খিদে)। ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে এ কি আশ্চর্য ভাষা ! কোন দূরে আমাদের বাংলিশ বা অন্য আত্মীয়স্বজনরা রয়ে গেছেন দূরদ্বীপবাসিনী কে জানে? কোনও মাঙ্গলিক কাজে কিংবা ভূমিকম্পের সময় বাঙ্গালি হিন্দুরা যে ‘উলু’ দেয়, আমাদের ত্রিপুরায় বলে ‘ জুকার ‘ তেমন জুকার দিতে ভারতের আর কোথাও দেখিনি। কিন্তু আফ্রিকার কোনও প্রান্তে নাকি বিয়ের আসরে মহিলারা দল বেঁধে জুকার দেয়। ওই রীতি কি আফ্রিকা থেকে বাংলায় এসেছে নাকি বাংলা থেকে আফ্রিকায় গেছে?
বাঙালিরা সমুদ্রযাত্রায় অভ্যস্ত ছিল সুদূর অতীতেই। এখনও পৃথিবীর সব সমুদ্রেই চট্টগ্রাম ও সিলেটের নাবিকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমরা বিজয় সিংহের লঙ্কা বিজয়ের গল্প শুনেছি। শ্রীলঙ্কার প্রাচীন গ্রন্থ ‘মহাবংশম’ এ-ও তাঁদের পূর্বজদের বঙ্গ ও উৎকল’ থেকে আসার কথা উল্লেখ রয়েছে। অথচ বিখ্যাত ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে বলেছেন সিংহলারা সম্ভবত গুজরাটের লাট অঞ্চল থেকে গিয়েছিল। লাট অঞ্চল থেকে গুজরাটি ব্রাহ্মণরা হাজারে হাজারে বঙ্গের সিলেটেও এসেছিল। সিলেটের ভাষা ও সংস্কৃতিতে ওই লাটদের বিপুল প্রভাব রয়েছে। সিলেটি খানাপিনা, সিলেটি সহবত।
সুনীতিবাবু বলেছেন, আমরা বলি দাঁত-টাত’, গুজরাটিরা বলে ‘দাঁত-বৎ’, সিংহলীরা তাই বলে। সিলেটিরাও অনেকটা গুজরাটিদের মতো বলে। অথচ ডিএনএ পরীক্ষায় সিংহলীদের সঙ্গে বাঙালিদের মিল পাওয়া গেছে। তাহলে কোনটা ঠিক ? শুধুভাষাতত্ত্বদিয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর সন্ধান সম্ভব নয়। নৃতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সাহায্য নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি যৌথ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। ত্রিপুরা রাজ্যে বাঙালি ও ১৭টি জনজাতির মানুষ কয়েক শতাব্দী ধরে পাশাপাশি বসবাস করার ফলে বাংলা ও ককবরকের অনেক শব্দ এক। এখন কোন শব্দটি কোন ভাষা থেকে কোন ভাষায় গিয়েছে তা বলা মুশকিল!
