কবিতা
দেখেছি ঠাকুমা কেমন নিজের ভেতর ঢুকে যাচ্ছেন…
অমিত কাশ্যপ
সুকেশিনী
সে এক শীত ভোর, আশপাশ তখনো জেগে ওঠেনি
তখনই স্নান, তখনই বাসি কাজ সারা
ভিটের সঙ্গে তুলসী-মঞ্চ, প্রণাম করছেন সুকেশিনী দেবী
গায়ে জ্যোৎস্না-চাদর, হাত দুটি নিরাভরণ
সুকেশ হয়তো কখনো ছিল, আমি দেখিনি
সুকেশিনী ঠাকুমা বাড়ির শেষ কথা
দিনের শুরুতে কুলুঙ্গী থেকে গুনে গুনে পয়সা বের করতেন
আমরা দেখতাম, কুলুঙ্গীতে উপচে পড়া অতীত
দাদুকে দেখিনি, বড়মাপের একখানা ছবি বৈঠকখানায়
রাসভারি, গলায় মস্ত সোনার চেন
ব্যবসাদার মানুষ, জমিজিরেত, পুকুর, আরও কত কি
একান্নবর্তী পরিবার, সে সময় রোজই নিমন্ত্রণবাড়ি
বয়স যত ছোট হতে থাকে, বাঁধন সব আলগা হয়
দেখেছি ঠাকুমা কেমন নিজের ভেতর ঢুকে যাচ্ছেন
শহর থেকে বাবা ফিরেছেন, শুধু বললেন, অমু এলি
বিন্দুবাসিনী
অমু, অম্লান, বাবা, ঠাকুমা দেওয়ালে স্থান নিতেই
পিসিমা সেই জায়গা নিলেন, তাঁকেও কোন দিন
রঙিন বসনে দেখিনি, সেই জ্যোৎস্নাচাদর গায়ে
সেই শীত ভোরে স্নান, প্রণাম মন্ত্র বলতে বলতে
দাওয়া পেরিয়ে হেঁসেলে প্রবেশ
এখন তিনিই বাড়ির শেষ কথা, সংসার ছোট হয়ে আসছে
সময় গড়িয়ে গেলে যা হয়, আমরা এখন একটু একটু সদর যাচ্ছি
বাবার অবসর জীবন এগিয়ে আসছে, ক্লান্ত ভীষণ
কুলুঙ্গীতে বাবার অতীতও জমা হচ্ছে
পিসিমা রাতে কেরোসিনের কুপি উসকে দিয়ে বলছেন
অমু, আমাদের কমু বড় হয়, ভাবতে থাক
দিনকাল ভালো নয়, রাতে ঘুম হয় না
কমু, আমার ছোট বোন, কমলীনি
কবির জন্ম ৬ আগস্ট ১৯৫৫। পেশায় অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক। আজ পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ২৩। কাব্যচর্চার জন্য বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অনাময় দত্ত পুরস্কার, শ্রীশ্রী ভক্তিবিনোদ স্মৃতি পুরস্কার, অমূল্যচন্দ্র দেবনাথ স্মৃতি পুরস্কার, পারানি পুরস্কার, আরাত্রিক সাহিত্য সম্মান, চোখ সম্মাননা, মিলনবীথি স্মারক পুরস্কার, মুর্শিদাবাদ জেলা কবিতা আকাদেমি সম্মান, ডলি মিদ্যা স্মৃতি পুরস্কার, সুবোধ কুমার রায় স্মৃতি পুরস্কার প্রমুখ।
কবিতা
ভালবাসার মনে পড়ে না স্মৃতিকে..চোখে অন্ধ অভিমান
অভিজিৎ রায়
টাইমকল
রাত্রিগুলো ফুরিয়ে গেলে
অন্ধকার ফুরিয়ে যাবে
এমন কথা বলে
গলির মোড়ে একলা ছেড়ে
গিয়েছিল কে চলে?
তার খোঁজে কে হাঁটছে আজও
রাস্তা ছেড়ে ঘরে
আলোর খোঁজে অন্ধকার
সত্যি করে মরে?
ভালবাসায় মরছে যারা
তারাই কেবল জানে
মানুষ মরে সবসময়ই
ভালোবাসা মরে না।
অন্ধকারে খুঁজছে গলি
স্মৃতির আলো জানে
ভালবাসার আজও তাকে
সত্যি মনে পড়ে না!
জানলাগুলো একলা কাঁদে
গলির চোখে জল;
লম্বা লাইন ভোরবেলাতে
হাসে টাইমকল।
এবার পড়ুন আরও কবিতা বিশিষ্ট কবিদের কলমে
গলির ভাঁজে
একজীবনে ঠিক কতবার
বাসতে পারো ভালো?
অন্ধকার এ প্রশ্ন করে
চুপ থাকে তার আলো।
গলির ভাঁজে সন্ধে এলে
বাইক থামে মোড়ে;
অন্ধকারের মিষ্টি হাওয়া
বইছে একটু জোরে।
জোর খাটানো গল্প লেখে
নতুন প্রেমের গান;
আলোর চোখে ভাঙছে ছায়া
অন্ধ অভিমান।
টাইমকলে জল না এলে
অন্ধকার নামে
স্তব্ধ মুখর ভালোবাসা
উত্তেজনায় ঘামে।
এবারপড়ুন আরও গল্প বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের কলমে
কবির জন্ম ২৪ মার্চ ১৯৭০। বাণিজ্যে স্নাতক। জীবিকা রূপে বেছে নিয়েছেন প্রকাশনা ও মুদ্রণ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৪। গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ২টি। এছাড়াও প্রকাশিত উপন্যাস ও মুক্তগদ্য গ্রন্থের সংখ্যা যথাক্রমে ৩ ও ৪। কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন ১৯৮৬ সালে। ‘আকাশ’ নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন।
কবিতা
তর্জনী মাথা ছুঁলে নকশিকাঁথা দিয়ে ভয় দেখিয়েছি
রফিক উল ইসলাম
তর্জনী
আমার দিকে তর্জনী তোলা খুবই সহজ!
আমার জেগে থাকা আমার দিকে তর্জনী তোলে!
আমার কথা বলতে চাওয়া! আমার স্তব্ধ হয়ে থাকা
আমার দিকে তর্জনী তোলে, আমার ঘুমিয়ে পড়তে চাওয়া
আমার স্বপ্ন দেখতে চাওয়া…
সব্বাই, সব্বাই!
আমি কেন ‘অমন’, আমি কেন ‘তেমন’ হতে
পারলাম না? আমি কেন বুক থেকে পাঁজর খুলে
পথে পথে ছড়িয়ে ফেলি
অচেনা কোন নূপুরধ্বনির প্রতীক্ষায়? কেন? কেন ?
লাল চোখ নিয়ে মৃত্যুও আমার দিকে তর্জনী তোলে…
সব বুঝেও আমার অপরাধ কমাতে পারি না কিছুতেই
সেই সুযোগে তোমাদের সহস্র রজনী
আমার অরক্ষিত বুক ছিন্নভিন্ন করে দেয়। আমার দু-চোখের
প্রতিটা জলের ফোঁটা
তোমাদের হিংস্র নখ রক্তাক্ত করে তোলে।
আমি অন্ধ হয়ে যাই, বাকরুদ্ধ হয়ে যাই, এই পৃথিবীর
আলো আর অন্ধকার থেকে পালাতে পালাতে
কঠিন এক সূর্যের দেশে
পড়ে থাকি মরু-পাথরের মতন, যদি কোন দিন
চাঁপাফুলের পাপড়ির মতন, কোন তর্জনী
আমার বহুজন্মের রুক্ষ আর জটাধরা মাথা
স্পর্শ করে দেয়!
নকশিকাঁথা
ধ্বংস এসেছিল পিঠে-পায়েস নিয়ে, আর আমরা
কব্জি ডুবিয়ে খেলাম! এতই অসতর্ক আর ক্ষুধার্ত ছিলাম
ধ্বংসও যে পিঠে-পায়েসের ছদ্মবেশ নিতে পারে
অনুমান করতে পারিনি।
একটি পুরানো নকশিকাঁথাকেই তো রিফু করতে করতে
জড়িয়ে-মড়িয়ে হাড়কাঁপানো শীতগুলিকে
ভয় পাইয়ে রেখেছিলুম। কাঁথার গায়ে যেমন আমাদের
ছুঁচ-সুতোর আলপনা লেপটে ছিল, ঠিক তেমনই ছিল
ছুঁচ বিঁধে আঙুল থেকে ঝরে পড়া ফোঁটা ফোঁটা
রক্তের গোধূলি!
কাঁথাটিই ছিল অবসরের আড়বাঁশি, হারিয়ে যাওয়া
রথের মেলা, কাঁথাটিই ছিল আমাদের প্রাচীন জাহাজঘাটা
যেখান থেকে আস্ত একটি জাহাজ
সমুদ্রে ভাসানোর কৌশলে
নিমগ্ন ছিলাম আমরা!
ধ্বংস যে সর্বদাই বিষাক্ত তীর-ধনুক কিংবা
গোলা-বারুদ সঙ্গে নিয়ে আসবে, এমনটি তো নয়!
এতসব বুঝে ওঠার আগেই আমাদের রিফু করা নকশিকাঁথাটি
ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল
পিঠে-পায়েসের ওপর হামলে পড়তে গিয়ে!
জন্ম দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায়। চরকায় সুতো কাটা, তাঁত বোনা, ঠাকুরঘরের মাটির দাওয়ায় বসে আরতির লগ্নে সমবেত ‘রামধনু’ গাওয়া। ফলশ্রিতি হিসাবে বাবার একঘরে হয়ে যাওয়া – এসব কিছু মিলিয়ে শিক্ষাজীবন যার শুরু সরিষা রামকৃষ্ণ মিশনে। গত শতকের আটের দশক থেকে পরিপূর্ণ কবিতাযাপন। বাংলা ভাষার প্রায় সব উল্লেখযোগ্য পত্রপত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতা। দীর্ঘ চোদ্দ বছর ধরে সম্পাদনা করে আসছেন কবিতা এবং কবিতা বিষয়ক পত্রিকা ‘গ্রামনগর’।
কবিতা
জীবিকার ঘামে ভরা জেব্রা ক্রসিং…খসে পড়ে ক্রিয়াপদ
মন্দিরা ঘোষ
সিনোপসিস
একটা ভিড়ের সিনোপসিসে
কিছু দৃশ্যদাগ জেগে ওঠে
কাদার মতো থকথকে রোদ মেখে
স্থির গাছ ও রাস্তার ভূমিকা
ক্লান্তির শব বয়ে ফেরা সন্ধের মলাটে
কোলো তুলসিতলা নেই
জীবিকার ঘামে ভরাট শহরের জেব্রা ক্রসিং
একটি নির্জন রাস্তার ডাক মাঝে মাঝে
উদাসীন আঁকে জানলায়
বন্ধ ডাকঘরে এখনও আলোর চিঠি হাতে
দাঁড়িয়ে থাকে অরণ্যের পোস্টম্যান
স্কিৎজোফ্রেনিক রাতের মুখ থেকে
খসে পড়ে পাখিচিহ্নের ক্রিয়াপদগুলি
উপমা
উপমা থেকে গড়িয়ে পড়ে রাত
ছায়া ছায়া চাতক স্পৃহায়
তির ও ফলার আশ্চর্য
মাসুলের ভিতর দুমড়ে যাচ্ছে ভুল
তলিয়ে যাওয়া পতনমুহূর্তের সময়টুকু
সকলেই অভিনয় ভুলে যায়
বাকিটা কাদা মাটি জলের অনুগত মঞ্চসফল
বোঁটায় অনুপাতহীন মাঝদুপুর
আর নদীশূন্যতা
গভীরের অন্তিমে জেগে থাকে জল
জন্ম পশ্চিমবঙ্গের পূর্ববর্ধমান জেলার কালিকাপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। শৈশব থেকেই যৌথপরিবার ও সাংস্কৃতিক আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা।প্রকৃতির সাথে নিবিড় যোগাযোগ ও কবিতার লালন তখন থেকেই। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের স্নাতক।বিবাহসূত্রে হাওড়ার শিবপুরে বসবাস। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, লিটিল ম্যাগাজিন ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লেখালেখি ছাড়াও চারটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। কাব্যগ্রন্থগুলি হলো জ্যোৎস্নাশরীরের ছবি,মিশুক শব্দের মলাট, অম্বালিকার কিশোরীগন্ধ এবং ভাঙা দেরাজের গল্প।

